উইকিশৈশব:সৌরজগৎ/শুক্র

উইকিবই থেকে

শুক্র বিষয়ক তথ্য:

  • শুক্রগ্রহে অবতরণকারী প্রথম অনুসন্ধানী মহাকাশযান ভেনেরা ৭ মাত্র ২৩ মিনিট পরেই শুক্র গ্রহের প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে ধ্বংস হয়ে যায়।
  • শুক্র পৃষ্ঠের প্রায় সকল বৈশিষ্ট্যই নারীদের নামে নামকরণ করা হয়েছে।
  • শুক্রের ১ দিন পৃথিবীর ১১৭ দিনের সমান!
  • প্রস্তাব করা হয়েছে, শুক্রের মেঘে কিছু আণুবীক্ষণিক জীব বাস করতে পারে।

শুক্র হচ্ছে সৌরজগতের দ্বিতীয় গ্রহ। সূর্য থেকে দূরত্বের ভিত্তিতে বুধের পরেই এর অবস্থান। এটি একটি স্থলভূমি বিশিষ্ঠ বা পাথুরে গ্রহ। অর্থাৎ, ধারণা করা হয় যে এটি আমাদের পৃথিবীর মতই পাথর বা শীলা দ্বারা গঠিত।

শুক্র। সাদা মেঘের কারণে এই ছবিতে এর পৃষ্ঠভাগ দেখা যাচ্ছে না।
সৌরজগৎ

ভূমিকা
আমাদের সৌরজগৎ
সূর্য
বুধ
শুক্র
পৃথিবী
চাঁদ
মঙ্গল
গ্রহাণুপুঞ্জ
বৃহস্পতি
শনি
ইউরেনাস
নেপচুন
প্লুটো
ধূমকেতু
কুইপার বেষ্টনী
উর্ট মেঘ
পরিভাষাকোষ
পরীক্ষা

শুক্র কত বড়?[সম্পাদনা]

শুক্র ও পৃথিবীর তুলনা

শুক্র পৃথিবী থেকে সামান্য ছোট। তাই শুক্রকে কখনও কখনও পৃথিবীর "যমজ গ্রহ" বা "বোন গ্রহ" হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শুক্রের ব্যাস প্রায় ১২,১০০ কিমি। গবেষণার জন্য গ্রহটিতে বেশ কয়েকটি অনুসন্ধানী মহাকাশযান পাঠানো হয়েছে।

এই গ্রহের পৃষ্ঠভাগ কেমন?[সম্পাদনা]

রাডার ইমেজিং দ্বারা শুক্রপৃষ্ঠে মাত মনস

শুক্রের পৃষ্ঠ পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে খুব আলাদা। এটি খুব শুষ্ক এবং উত্তপ্ত। এর পৃষ্ঠ এতই গরম যে, সেখানে সীসা রাখলেও গলে যাবে। শুক্রের পৃষ্ঠের উপর বায়ুচাপ খুব বেশি। এর বায়ুমণ্ডলীয় চাপ পৃথিবীর সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১ কিলোমিটার (৩,২৮০ ফুট) গভীরে অনুভূত চাপের সমান।

শুক্রপৃষ্ঠের খাত, পৃথিবীতে নদী খাতের মতো দেখতে

শুক্র গ্রহের পৃষ্ঠভাগে নদীর মতো দেখতে খাত রয়েছে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন এসব খাত বিস্ফোরিত লাভার প্রবাহের ফলে সৃষ্টি হয়েছে। লাভা প্রবাহিত হতে হতে ঠান্ডা হওয়ার ফলে এসব খাতের সৃষ্টি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। "অস্বাভাবিক ধরণের আগ্নেয়গিরি" হচ্ছে শুক্র গ্রহের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য যা অন্যান্য গ্রহে সাধারণত দেখা যায় না। এসব আগ্নেয়গিরিকে অ্যারাকনোইড বলা হয়। এগুলো সৌরজগতে থাকা অন্যান্য আগ্নেয়গিরি থেকে আলাদাভাবে গঠিত হয়েছে। এগুলো ঠিক কীভাবে গঠিত হয়েছিল, তা আমরা এখনও জানি না। তবে শুক্র গ্রহে পৃথিবীর মতো আগ্নেয়গিরিও রয়েছে।

শুক্র পৃষ্ঠের কিছু অংশ মহাদেশের মতো দেখতে। এর মধ্যে বৃহত্তম অঞ্চলগুলির নাম ইশতার টেরা (ইশতারের দেশ, ইশতার ছিলেন শুক্রের অনুরূপ ব্যাবিলনীয় দেবী)। পৃথিবীর মহাসাগরের নিচে থাকা গভীর অববাহিকার মতো অববাহিকাও শুক্রের পৃষ্ঠে আবিষ্কৃত হয়েছে। কিন্তু শুক্রের এসব অববাহিকায় কোনও পানি নেই। শুক্রগ্রহে পর্বতশ্রেণী এবং উল্কা পাতের ফলে সৃষ্টি হওয়া গর্তের মতো বৈশিষ্ট্যও পাওয়া গেছে। শুক্র গ্রহের অন্যতম সর্বোচ্চ পর্বত ম্যাক্সওয়েল মন্টেস পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বত মাউন্ট এভারেস্টের চেয়ে প্রায় ১১ কিলোমিটার উঁচু।

এই গ্রহের যে প্রান্তে রাত থাকে, সেখানে আশেন লাইট নামে একটি অদ্ভুত প্রভাব লক্ষ করা যায়। ঠিক কোন কারণে, শুক্রের অন্ধকার দিকে একটি সূক্ষ্ম আলোক আভা দেখা যায়, এই সম্পর্কে বিভিন্ন তত্ত্ব রয়েছে। বর্তমানে মিথ্যা প্রমাণিত হওয়া এই সম্পর্কে উত্থাপিত প্রাচীনতম তত্ত্বগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে, শুক্রগ্রহে ভিনগ্রহী জীবেরা একটি নতুন শুক্রীয় সাম্রাজ্য উদযাপন করছিল। বর্তমানে, অনেক বিজ্ঞানীই বিশ্বাস করেন: কার্বন ডাই অক্সাইডের উচ্চ ঘনত্ব রয়েছে। এই কার্বন ডাই অক্সাইড যখন সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি দ্বারা আঘাত প্রাপ্ত হয়, তখন তারা কার্বন মনোক্সাইড এবং অক্সিজেনে রূপান্তরিত হয় এবং সবুজ আলো নির্গত করে। পুরো রাসায়নিক পদ্ধতিটি হচ্ছে CO2 → CO + O

একটি স্ট্যাম্পে চিত্রিত হিসাবে ভেনেরা ১৩ ল্যান্ডার। এটি শুক্রগ্রহে বৈজ্ঞানিক পরিমাপ করে এবং শুক্রের পৃষ্ঠ থেকে ছবি তুলে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিল।

শুক্রগ্রহে একটি দিন কতক্ষণ?[সম্পাদনা]

শুক্র গ্রহ সূর্যের চারদিকে একবার ঘুরে আসতে পৃথিবীর হিসেবে প্রায় ২২৫ দিন সময় নেয়। শুক্র সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহগুলির বেশিরভাগের বিপরীত দিকে আবর্তিত হয়। শুক্র নিজের অক্ষের চারপাশে নিজ অক্ষকে কেন্দ্র করে খুব ধীরে আবর্তন করে। গ্রহটি নিজের অক্ষের চারদিকে একবার ঘুরতে পৃথিবীর হিসেবে ১১৭ দিন সময় নেয়। অর্থাৎ, শুক্র গ্রহের ১ দিন পৃথিবীর ১১৭ দিনের সমান! শুক্রগ্রহে একদিন দুপুর থেকে দুপুর পর্যন্ত বছরের দৈর্ঘ্যের পাশাপাশি ঘূর্ণনের সময়ের উপর নির্ভর করে এবং প্রায় ১১৭ টি পৃথিবীর দিন। আবার ধীর গতির কারণে দীনের দৈর্ঘ্য অনেক বেশি হওয়ায় শুক্র গ্রহের এক বছরে মাত্র দুইবার দিন-রাত্রি দেখা যায়।

শুক্রগ্রহে এক বছর কতদিনে?[সম্পাদনা]

শুক্রগ্রহে এক বছর প্রায় ২২৫ পৃথিবী দিনের দীর্ঘ। এটি শুক্রকে তার অক্ষে ঘোরাতে এবং দুটি শুক্র দিনের কম সময় নেয়।

শুক্র কী দিয়ে তৈরি?[সম্পাদনা]

শুক্রের পৃষ্ঠ, এর ভূত্বক, শিলা ছাড়া আর কিছুই আচ্ছাদিত নয়। কিন্তু, শুক্রের কেন্দ্রমণ্ডল নিকেল-লোহা দিয়ে তৈরি। শুক্রের চারপাশের বায়ুমণ্ডল খুব পুরু এবং কার্বন ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেন এবং বিষাক্ত গ্যাস দিয়ে তৈরি। এর ফলে শুক্রের বায়ুমণ্ডলের চাপ ও তাপ অনেক বেশি।

শুক্রের মাধ্যাকর্ষণ মানুষকে কতটা টানবে?[সম্পাদনা]

আপনি যদি শুক্রগ্রহে থাকতেন, তবে এটি আপনাকে পৃথিবীর মতো প্রায় সমান ভাবেই নিচের দিকে টানত। এর বায়ুমণ্ডল ভূপৃষ্ঠে পৃথিবীর স্বাভাবিক সমুদ্রপৃষ্ঠের চাপের ৯০ গুণেরও বেশি চাপ প্রয়োগ করে।

কে শুক্রগ্রহ আবিষ্কার করেছে?[সম্পাদনা]

যেহেতু শুক্র পৃথিবীর চেয়ে সূর্যের কাছাকাছি, আমরা সর্বদা এটিকে আকাশে সূর্যের কাছাকাছি দেখি। সুতরাং এটি কেবল পূর্ব আকাশে সূর্যোদয়ের ঠিক আগে বা পশ্চিম আকাশে সূর্যাস্তের ঠিক পরে আমাদের নিকট প্রদর্শিত হয়। অনেক সংস্কৃতি ভেবেছিল সকালে শুক্র এবং সন্ধ্যায় শুক্র দুটি পৃথক জিনিস। প্রাচীন রোমানরা সন্ধ্যার বস্তুটিকে বলত "ভেনাস" (রোমান প্রেমের দেবীর নামানুসারে) এবং সকালের বস্তুকে বলত লুসিফার (যার অর্থ আলোবাহক- একজন চাকর যিনি সূর্যের পথ আলোকিত করার জন্য হাতে আলো নিয়ে সূর্যের রথের আগে আগে হেঁটে আসছেন)। কে প্রথম দুটোকেই একই বস্তু ভেবেছিল, তা কারও জানা নেই। এই বিষয়ে প্রথম পরিচিত লিখিত বর্ণনা প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগের অর্থাৎ, ১৫৮১ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আমমিসাদুকার ভেনাস ট্যাবলেটে পাওয়া যায়।

ভেনেরাস ৯-১৪ এবং ভেগাস যেখানে অবতরণ করেছিল সেই স্থানের একটি মানচিত্র।

প্রায় তিন হাজার বছর পরে, ১৬১০ সালে, ইতালীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলি একটি দূরবীক্ষণ যন্ত্র ব্যবহার করে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন যে চাঁদের মতো শুক্রেরও বিভিন্ন পর্যায় বা দশা রয়েছে। শুক্রের এসব পর্যায় ঘটে কারণ একই সময়ে এর কেবল মাত্র সূর্যের দিকে মুখ করে থাকা দিকটি আলোকিত হয়। শুক্রের পর্যায়গুলি কোপারনিকাসের তত্ত্বকে সমর্থন করেছিল যে গ্রহগুলি সূর্যের চারপাশে ঘুরে। এরপর কয়েক বছর পর ১৬৩৯ সালে যিরমিয় হররকস নামে একজন ইংরেজ জ্যোতির্বিজ্ঞানী শুক্রের একটি ট্রানজিট পর্যবেক্ষণ করেন। শুক্র যখন পৃথিবী এবং সূর্যের ঠিক মাঝখানে দিয়ে যায় তখন পৃথিবী থেকে দিনের বেলায় শুক্রগ্রহ সূর্যের দিকে একটি ছোট বিন্দু হিসাবে দৃশ্যমান হয়। ১৭৬১ সালে একজন রুশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী মিখাইল লোমনসভ শুক্রের আরেকটি ট্রানজিট দেখতে দেখতে দেখেন যে শুক্রের একটি বায়ুমণ্ডল রয়েছে।

১৯২০ এর দশক পর্যন্ত শুক্র সম্পর্কে আর বেশি কিছু আবিষ্কৃত হয়নি। এরপর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফ্র্যাঙ্ক রস শুক্রকে অতিবেগুনি আলো ব্যবহার করে পর্যবেক্ষণ করেন - যে আলো রোদে পোড়ার কারণ হয় - এবং প্রথমবারের মতো শুক্রগ্রহে মেঘের গঠন দেখেছিল।

যাইহোক, পৃথিবী থেকে শুক্র সম্পর্কে শুধু এত কিছুই জানা যায়। মহাকাশ অনুসন্ধানের মাধ্যমে শুক্রের প্রথম সফল ছবিগুলি ১৯৬২ সালে মেরিনার ২ তুলেছিল। মেরিনার ২ ছিল প্রথম অনুসন্ধানী মহাকাশযান যা সফলভাবে অন্য গ্রহ পর্যবেক্ষণের জন্য পাঠানো হয়েছিল। এটি দুটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস দেখিয়েছে: শুক্রের কার্যত কোনও চৌম্বক ক্ষেত্র নেই, এবং শুক্রের তাপমাত্রা ৪৯০ থেকে ৫৯০ কেলভিন। এটি পৃথিবীতে একটি ওভেনের ভিতরের মতো গরম।

শুক্রের প্রথম লিখিত রেকর্ড। এটি ২১ বছরেরও বেশি সময় ধরে শুক্রের গতিবিধি বর্ণনা করে।

কার নামে গ্রহটির নামকরণ করা হয়েছে?[সম্পাদনা]

বাংলা ভাষায় শুক্রের নামকরণ করা হয়েছে প্রাচীন বৈদিক হিন্দুধর্মের পৌরণিক ঋষি ও দেবতা এবং অসুর বা দৈত্যদের গুরু শুক্রাচার্যের নামানুসারে। অন্যদিকে ইংরেজি ভাষায় শুক্রের "ভেনাস" নাম রাখা হয়েছে রোমান প্রেমের দেবীর নামে।

এটি ভোরের ঠিক আগে বা সূর্যাস্তের ঠিক পরে উজ্জ্বলভাবে জ্বলজ্বল করতে দেখা যাওয়ার ফলে গ্রহটিকে কখনও কখনও বাংলায় শুকতারা ও সন্ধ্যাতারা এবং ইংরেজিতে মর্নিং স্টার ও ইভনিং স্টার বলা হয়। অ্যাজটেক এবং গ্রীকরা শুক্রকে দুটি নাম দিয়েছিল। একটি নাম ছিল সকালের জন্য এবং অন্যটি সন্ধ্যার জন্য।

যেহেতু শুক্র এবং পৃথিবী একই আকারের, বিজ্ঞানীরা শুক্রকে "পৃথিবীর বোন গ্রহ" বলেন। অনেক দিন ধরে বেশিরভাগ বিজ্ঞানী ভেবেছিলেন যে শুক্রে উদ্ভিদ, প্রাণী এবং সম্ভবত মানুষও রয়েছে। যাইহোক, যেহেতু শুক্র খুব বেশি গরম তাই আমরা এখন জানি যে সেখানে কোনও কিছুর পক্ষে থাকা অসম্ভব।

সেখানে যেতে মানুষের কত সময় লাগবে?[সম্পাদনা]

সেখানে যেতে প্রায় দেড় বছর সময় লাগতে পারে। তবে কোনও মানুষের পক্ষে শুক্রগ্রহে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]