বিষয়বস্তুতে চলুন

রন্ধনপ্রণালী:পুষ্টি উপাদন

উইকিবই থেকে

খাদ্যের উপাদান

[সম্পাদনা]

খাদ্যে ছ'টি উপাদান থাকে, যথা- শর্করা, প্রোটিন, স্নেহপদার্থ, খাদ্যপ্রাণ, খনিজ লবণ এবং জল

১. শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট :

[সম্পাদনা]

উপাদান : কার্বন, হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেন-- এই তিনটি উপাদান নিয়ে শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট গঠিত। শর্করায় হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন ২:১ অনুপাতে থাকে। শর্করার আণবিক সংকেত C
n
(H
2
O)
n
; যেমন গ্লুকোজ C
6
H
12
O
6
, সুক্রোজ C
12
H
22
O
11
ইত্যাদি।

উৎস : ধান বা চাল, গম, ভূট্টা, বাজরা, আলু, ওল, কচু, বীট, গাজর ইত্যাদিতে স্বেতসার বা স্টার্চ; খেজুর, আঙ্গুর, আপেল ইত্যাদিতে দ্রাক্ষাশর্করা বা গ্লুকোজ; শাক-সবজি, বেল, তরমুজ, থোড় ইত্যাদিতে সেলুলোজ; আম, কলা, কমলালেবু প্রর্ভতি পাকা ফলে ফলশর্করা বা ফুক্টোজ; চিনি, গুড়, মিছরী ইত্যাদিতে ইক্ষুশর্করা বা সুক্রোজ; দুধে দুগ্ধ শর্করা বা ল্যাক্টোজ এবং পাঁঠার যকৃৎ ও পেশীতে গ্লাইকোজেন বা প্রাণীজ শ্বেতসার পাওয়া যায়।

শ্রেণীবিভাগ : কার্বোহাইড্রেটের প্রত্যেক অণুতে সরল শর্করার এক বা একাধিক এককের উপস্থিতি অনুসারে কার্বোহাইড্রেটকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়ছে। যথা :

১. মনোস্যাকারাইড :যেসব শর্করা একটি মাত্র অণু দ্বারা গঠিত, তাকে মনোস্যাকারাইড বলে। যথা: গ্লুকোজ, ফ্রুকটোজ ও গ্যালাকটোজ।

২. ডাইস্যাকারাইড :যেসব শর্করা দুটি অণু দ্বারা গঠিত, তাকে ডাইস্যাকারাইড বলে। যেমন: সুক্রোজ, ল্যাকটোজ ও মলটোজ।

৩. পলিস্যাকারাইড :যেসব শর্করা অনেক অণু দ্বারা গঠিত, তাকে পলিস্যাকারাইড বলে। যেমন: স্টার্চ, গ্লাইকোজেন ও সেলুলোজ।

পুষ্টিগত গুরুত্ব বা কাজ :

  • দেহে কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি এবং তাপ শক্তি উৎপাদন শর্করার প্রধান কাজ।
  • সেলুলোজ জাতীয় খাদ্য কোষ্ঠবদ্ধতা দূর করে।
  • গ্লাইকোজেন যকৃত ও পেশীতে সঞ্চিত থাকে যা প্রয়োজনের সময় গ্লুকোজে পরিণত হয়ে দেহে অতিরিক্ত তাপ শক্তি উৎপাদন করে এবং রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ স্বাভাবিক রাখে। রক্তে গ্লুকোজের স্বাভাবিক পরিমাণ হল প্রতি ১০০ মিলি. রক্তে ৮০-১২০ গ্রাম।

এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে, প্রাণিজ প্রোটিন গ্রহণ না করেও শুধুমাত্র প্রচুর পরিমাণে শ্বেতসার জাতীয় খাদ্য খেয়ে মানুষ সুস্থ শরীরে দীর্ঘদিন যাবৎ বেঁচে থাকতে পারে। এই জন্য শ্বেতসার জাতীয় খাদ্যকে প্রোটিন বাঁচোয়া খাদ্য বলা হয়।

২. আমিষ বা প্রোটিন :

[সম্পাদনা]

উপাদান : কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন এবং নাইট্রোজেন সমন্বয়ে প্রোটিন গঠিত। অনেক সময় সালফার এবং ফসফরাসও প্রোটিনে থাকে। প্রোটিন-অণু অসংখ্য অ্যামাইনো অ্যাসিডের সমন্বয়ে গঠিত হয়।

উৎস : মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ছানা ইত্যাদিতে প্রাণিজ প্রোটিন এবং ডাল, সয়াবিন, বীন, গম ইত্যাদিতে উদ্ভিজ্জ প্রোটিন পাওয়া যায়। প্রানিজ প্রোটিনে অপরিহার্য অ্যামাইনো অ্যাসিডের প্রায় সব গুলিই থাকে বলে প্রাণিজ প্রোটিনকে প্রথম শ্রেণীর প্রোটিন বালা হয়।

শ্রেণীবিভাগ : প্রোটিনকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:
১. সরল প্রোটিন :যে সব প্রোটিন অন্য কোন উপাদানের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে না, তাদের সরল প্রোটিন বলে। যথা: অ্যালবুমিন, গ্লোবিউলিন, প্রোটমিন, হিস্টোন, গ্লায়াডিন, গ্লুটেলিন ইত্যাদি সরল প্রোটিনের উদাহরণ।

২. সংযুক্ত প্রোটিন :সরল প্রোটিন যখন অন্য কোন উপাদানের সঙ্গে যুক্ত থাকে ,তখন তাদের সংযুক্ত প্রোটিন বলে। যথা: হিমোগ্লোবিন, হিমোসায়ানিন, ফসফোপ্রোটিন, লাইপোপ্রোটিন ইত্যাদি।

৩. লব্ধ প্রোটিন :যে সব প্রোটিন পরিপাক নালীতে প্রোটিন জাতীয় খাদ্য পরিপাকের সময় উদ্ভূত হয়, তাদের লব্ধ প্রোটিন বলে। যথা: পেপটন, পেপটাইড ইত্যাদি।

পুষ্টিগত গুরুত্ব বা কাজ :

  • দেহের বৃদ্ধি, কোষ গঠন ও ক্ষয়পূরণ হল প্রোটিনের প্রধান কাজ।
  • তাপ শক্তি উৎপাদন।
  • দেহস্থ উৎসেচক, হরমোন ইত্যাদি সৃষ্টি করা।
  • অপরিহার্য অ্যামাইনো অ্যাসিডের চাহিদা পূরণ করা হল প্রোটিনের অন্যতম কাজ।

এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে, ১ গ্রাম প্রোটিন অণু দহন হলে ৪.১ কেসিএল তাপ শক্তি উৎপন্ন হয়। একজন প্রাপ্তবয়স্ক লোকের প্রত্যহ প্রায় ১০০-১৫০ গ্রাম প্রোটিন জাতীয় খাদ্যের প্রয়োজন।

৩. স্নেহপদার্থ বা ফ্যাট :

[সম্পাদনা]

উপাদান : কার্বন, হাইড্রোজেন, এবং অক্সিজেন নিয়ে স্নেহপদার্থ বা ফ্যাট গঠিত হয়। এখন অক্সিজেন অনুপাত শর্করা তুলনায় কম এবং শর্করার মত হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন ২:১ অনুপাতে থাকে না। ফ্যাট প্রকৃতপক্ষে অ্যাসিড এবং গ্লিসারলের সমন্বয়ে গঠিত এস্টার বিশেষ।

উৎস : বাদাম, নারিকেল, সরষে, রেড়ী বীজ, তুলা বীজ ইত্যাদিতে উদ্ভিজ্জ ফ্যাট এবং মাখন, ঘি, চর্বি ইত্যাদিতে প্রানিজ ফ্যাট থাকে। সাধারণ উত্তাপে যে সমস্ত ফ্যাট তরল অবস্থায় থাকে, তাদের তেল বলে।

শ্রেণীবিভাগ : ফ্যাট সাধারণত দু;রকমের হয়। যথা:
১. সরল ফ্যাট :যে সব ফ্যাট অন্য কোন উপাদানের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে না, তাদের সরল ফ্যাট বলে। যথা: ওয়াক্স বা মোম, ল্যানোলিন ইত্যাদি সরল ফ্যাটের উদাহরণ।

২. যৌগিক ফ্যাট :সরল ফ্যাট যখন অন্য কোন উপাদানের সঙ্গে যুক্ত থাকে ,তখন তাদের যৌগিক ফ্যাট বলে। যথা: ফসফোলিপিড, গ্লাইকোলিপিড, অ্যামাইনো-লিপিড ইত্যাদি।

পুষ্টিগত গুরুত্ব বা কাজ :

  • তাপ শক্তি উৎপন্ন করা ফ্যাট জাতীয় খাদ্যে প্রধন কাজ।।
  • ফ্যাট প্রানিদেহের তাপ নিয়ন্ত্রনে রাখে।
  • ফ্যাট মেদরুপে ভবিষ্যতের খদ্যের উৎস হিসাবে সঞ্চিত থাকে।
  • ফ্যাট A, D, E, K ভিটামিনকে দ্রবীভূত রাখে এবং এদের শোষণে সাহায্য করে।
  • ফ্যাট যকৃৎ থেকে পিওরস এবং অগ্ন্যাশয় থেকে অগ্ন্যাশয় রস নিঃসরণে সাহায্য করে।
  • স্নেহপদার্থ মলাশয় ও পায়ু পিচ্ছল করে মল নিঃসরণে সহায়তা করে।
  • কোলেস্টেরল নামক ফ্যাট থেকে ভিটামিন-ডি, ইস্ট্রোজেন, টেস্টোস্টেরণ নামক হরমোন উৎপন্ন হয়।

এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে, ১ গ্রাম অণু ফ্যাট দহন হলে ৯.৩ কেসিএল তাপ শক্তি উৎপন্ন হয়। একজন প্রাপ্তবয়স্ক লোকের প্রত্যহ প্রায় ৫০ গ্রাম স্নেহপদার্থ প্রয়োজন।

৪. খাদ্যপ্রাণ বা ভিটামিন :

[সম্পাদনা]

যে বিশেষ জৈব পরিপোষক সাধারণ খাদ্যে অতি অল্প পরিমাণে থেকে দেহের স্বআভাবিক পুষ্টি ও বৃদ্ধিতে সহায়তা করে এবং রোগপ্রতিরোধ শক্তি বৃদ্ধি করে, তাকে ভিটামিন বলে।

শ্রেণীবিভাগ : দ্রাব্যতা অনুসারে ভিটামিনগুলিকে দুভাগে ভাগ করা হয়। যথা:
১. তেল বা স্নেহপদার্থে দ্রবনীয় ভিটামিন :যে সব ভিটামিন তেল বা স্নেহপদার্থে দ্রবীভূত হয়, তাদের স্নেহপদার্থে দ্রবনীয় ভিটামিন বলে। যথা: A, D, E, K ।

২. জলে দ্রবনীয় ভিটামিন :যে সব ভিটামিন জলে দ্রবীত হয়, তাদের জলে দ্রবনীয় ভিটামিন বলে।। যথা: B, C এবং P ।

উৎস : ভিটামিন দুধ, ডিম, মাছ, মাংস, প্রানীদের যকৃৎ, মাছের যকৃৎ নিঃসৃত তেল, মাখন, উদ্ভিজ্জ তেল, বাদাম, ঢেঁকিছাটা চাল, লাল আটা, ছোলা, মুগ, বীট, গাজর, মটরশুঁটি, পালংশাক, টমেটো, বাঁধাকপি, ফুলকপি, লেবু, আম, আমলকি, আপেল ইত্যাদিতে পাওয়া যায়। ভিটামিনের এই সব উৎসের মধ্যে দুধ, ডিম, পালংশাক, টমেটো, মটরশুঁটি, কলা, আপেল ইত্যাদিতে বেশীর ভাগ ভিটামিন পাওয়া যায়। ভিটামিন A এবং D এর উৎস মোটামুটি এক, যেমন : কড্, হ্যালিবাট যকৃত নিঃসৃত তেল (লিভার অয়েল), মাখন, দুধ, ডিম,গাজর, বাঁধাকপি, ইত্যাদি। নারিকেল, সরষে, রেড়ী বীজ, তুলা বীজ ইত্যাদিতে উদ্ভিজ্জ ফ্যাট এবং মাখন, ঘি, চর্বি ইত্যাদিতে প্রাণিজ ফ্যাট থাকে। সাধারণ উত্তাপে যে সমস্ত ফ্যাট তরল অবস্থায় থাকে, তাদের তেল বলে।

পুষ্টিগত গুরুত্ব বা কাজ :

  • তাপ শক্তি উৎপন্ন করা ফ্যাট জাতীয় খাদ্যে প্রধান কাজ।
  • ফ্যাট প্রাণিদেহের তাপ নিয়ন্ত্রনে রাখে।
  • ফ্যাট মেদরুপে ভবিষ্যতের খাদ্যের উৎস হিসাবে সঞ্চিত থাকে।
  • ফ্যাট A, D, E, K ভিটামিনকে দ্রবীভূত রাখে এবং এদের শোষণে সাহায্য করে।
  • ফ্যাট যকৃৎ থেকে পিত্তরস এবং অগ্ন্যাশয় থেকে অগ্ন্যাশয় রস নিঃসরণে সাহায্য করে।
  • স্নেহপদার্থ মলাশয় ও পায়ু পিচ্ছিল করে মল নিঃসরণে সহায়তা করে।
  • কোলেস্টেরল নামক ফ্যাট থেকে ভিটামিন-ডি, ইস্ট্রোজেন, টেস্টোস্টেরন নামক হরমোন উৎপন্ন হয়।

এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে, ১ গ্রাম অণু ফ্যাট দহন হলে ৯.৩ কেসিএল তাপ শক্তি উৎপন্ন হয়। একজন প্রাপ্তবয়স্ক লোকের প্রত্যহ প্রায় ৫০ গ্রাম স্নেহপদার্থ প্রয়োজন।

পানি খাদ্যের একটি উপাদান। মানবদেহের জন্য পানি অপরিহার্য। দেহের গঠন এবং অভ্যন্তরীণ কাজ পানি ছাড়া চলতে পারে না। আমাদের দৈহিক ওজনের ৬০-৭০% পানি। আ"মাদের রক্ত মাংস, স্নাযূ, দাঁত, হাড় ইত্যাদি প্রতিটি অঙ্গ গঠনের জন্য পানি প্রয়োজন। দেহকোষ গঠন ও কোষের যাবতীয় শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াগুলো পানি ছাড়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়।