মঙ্গলকাব্য/অপ্রধান মঙ্গলকাব্য/সুবচনীমঙ্গল

উইকিবই থেকে

সুবচনীমঙ্গল বা শুভদামঙ্গল প্রকৃতপক্ষে একটি ক্ষুদ্র পাঁচালি-কাব্য। এই কাব্যের কবিগণ কেউই তাঁদের কাব্যকে মঙ্গলকাব্য হিসেবে উল্লেখ করেননি। কিন্তু অধ্যাপক আশুতোষ ভট্টাচার্য দু’টি কারণে এই কাব্যটিকে মঙ্গলকাব্যের তালিকাভুক্ত করেছেন: প্রথমত, মঙ্গলকাব্যের অনেক কবিই তাঁদের রচনাকে পাঁচালি বলে উল্লেখ করেছিলেন; এবং দ্বিতীয়ত, সুভদামঙ্গলের একটি পুথির পুষ্পিয়ার অন্তে লেখা রয়েছে "ইতি শুভদামঙ্গল সমাপ্তং"। কাব্যটির বিষয়বস্তু সুন্দর বা শুভকার্যের লোকিক দেবী শুভচণ্ডী(শুভবাচনী) বা সুবচনীর মাহাত্ম্যকীর্তন। দ্বিজ মাধব/মাধব দাস ও দ্বিজ শ্রীরামজীবন ভণিতায় লেখা সুবচনীমঙ্গলের কয়েকটি পুথি আবিষ্কৃত হয়েছে। সব ক’টিই অধুনা পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলা থেকে।

সুবচনী[সম্পাদনা]

সুবচনী বাংলার এক লৌকিক দেবী। নামান্তরে তিনি শুভবাচনী, শুবুচুনী বা শুভচণ্ডী নামেও পরিচিতা। ক্রিয়াকাণ্ডবারিধি গ্রন্থে সুবচনীর যে ধ্যানমন্ত্রটি পাওয়া যায় তা নিম্নরূপ:

রক্তা পদ্মচতুর্মুখী ত্রিনয়না বস্ত্রার্ধকারাঙ্কিতা
পীনোত্তুঙ্গকুচা দুকুলবসনা হংসাধিরূঢ়া পরা।
ব্রহ্মানন্দময়ী কমণ্ডলুকরাভীতিহস্তা শিবা
ধ্যেয়া সা শুভবাচনী ত্রিজগতাং সর্বাপদুদ্ধারিণী।।

অনুবাদ: রক্তবর্ণা, পদ্মতুল্য চতুরাননা, ত্রিনয়নী, অর্ধচন্দ্র-শোভিতা, পীনোন্নতপয়োধরা, দুকুলবসনা, হংসারূঢ়া, ব্রহ্মানন্দময়ী, কমণ্ডলুধারিণী ও অভয়হস্তা, কল্যাণকারিণী, সকল আপদ হতে ত্রিভুবনকে উদ্ধারকারিণী শুভবাচনীকে ধ্যান করবে।

চতুরানন, হংসবাহন, ত্রিনয়ন, কমণ্ডলু ও অভয়মুদ্রা পৌরাণিক দেবী ব্রাহ্মী বা ব্রহ্মাণীর বৈশিষ্ট্য। আবার হংসবাহন ও পীনস্তন বৈদিক-পৌরাণিক দেবী সরস্বতীরও বৈশিষ্ট্য। অপরপক্ষে রক্তবর্ণ, ত্রিনয়ন ও অর্ধচন্দ্র পৌরাণিক দেবী দুর্গা-চণ্ডীর বৈশিষ্ট্য। তাছাড়া সুবচনীর পূজামন্ত্রটিও হল "ওঁ সুবচনীদুর্গায়ৈ নমঃ"। এই কারণে ড. হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য সুবচনীকে দুর্গা, ব্রাহ্মী ও সরস্বতী এই তিন শাক্ত দেবীর সংমিশ্রিত রূপ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে, "…দেবী দুর্গাই লৌকিক মেয়েলী ব্রতে সুবচনীতে রূপায়িত হয়েছেন।" (হিন্দুদের দেবদেবী: উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, তৃতীয় পর্ব, পৃ. ৩৩৮)

সুবচনী ব্রত[সম্পাদনা]

সাধারণত বিবাহ অনুষ্ঠানের পরে নবদম্পতির মঙ্গল কামনায় সুবচনীর পূজা করা হয়। এছাড়া বাড়িতে কোনও শুভকর্ম উপলক্ষ্যেও সুবচনীর পূজা করা হয়। সুবচনীর ব্রতকথা অনুযায়ী, এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ বালক রাজার খোঁড়া হাঁস মেরে খেয়ে রাজরোষে কারারুদ্ধ হলে দেবী সুবচনীর কৃপায় মুক্তিলাভ করে ও রাজার জামাই হয়। উঠানে একটি ছোটো পুকুরের আকারে গর্ত খুঁড়ে সেটিকে দূর্বা ঘাস দিয়ে পূর্ণ করা হয়। তারপর একটি শিলনোড়ার আকৃতির পাথর সিঁদুরলিপ্ত করে সেই গর্তের মধ্যে স্থাপন করা হয় এবং কলা দিয়ে একুশটি হাঁস প্রস্তুত করে সেই গর্তের পাশে রাখা হয়। হাঁসগুলির মধ্যে একটিকে খোঁড়া হাঁস বলে নির্দেশ করা হয়। কোথাও কোথাও একুশটি হাঁস এঁকে তার উপর পান-সুপারি ও কলা দিয়ে পূজা করা হয়। পূজার শেষে একজন বালক একটি কলা কেটে খেয়ে খোঁড়া হাঁস খাওয়ার ঘটনাটি অভিনয় করে। পূর্ববঙ্গে (অধুনা বাংলাদেশ) সুবচনী পূজার বিশেষ কিছু রীতি ছিল। কিন্তু সেখানে সুবচনীর পাঁচালি বা মঙ্গলকাব্য জাতীয় কোনও পুথি পাওয়া যায়নি।

ব্রতকথা[সম্পাদনা]

সুবচনী দেবীর ব্রতকথাটি নিম্নরূপ:

কলিঙ্গ রাজ্যে এক বিধবা ব্রাহ্মণী বাস করত। ভিক্ষাবৃত্তি করে অতিকষ্টে সে তার পুত্রের উপনয়ন সংস্কার করিয়েছিল। পাঠশালায় পড়ার সময় ব্রাহ্মণীর পুত্র অন্যান্য পোড়োদের নানাপ্রকার সুখাদ্য খেতে দেখে নিজের মায়ের কাছে সেই রকম খাবার চায়। দরিদ্র ব্রাহ্মণী উত্তম খাদ্য ক্রয় করতে তার অপারগতার কথা জানালে বালক পরদিন সকালে সারা শহর ঘুরে রাজার হংসশাল থেকে একটি খোঁড়া হাঁস চুরি করে আনে। ব্রাহ্মণী সেই হাঁসের মাংস রান্না করে দিলে বালক পরম তৃপ্তি সহকারে তা গ্রহণ করে। এদিকে হংসশালে খোঁড়া হাঁসটিকে দেখতে না পেয়ে রাজা রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠেন। রাজদূত ব্রাহ্মণীর ঘরের সামনে ছাইগাদায় হাঁসের পাখা দেখে বালককে ধরে আনে রাজার কাছে। ক্রুদ্ধ রাজা বালকের মৃতুদণ্ড দেন। সেই কথা শুনে ব্রাহ্মণীর মাথায় বজ্রাঘাত হল। সেই সময় গ্রামে এক বাড়িতে সুবচনী পূজা হচ্ছিল। ব্রাহ্মণী সেখানে গিয়ে পুত্রের মুক্তিকামনায় সুবচনীর কাছে মানত করে। রাত্রে দেবী রাজাকে স্বপ্ন দিয়ে বলেন, রাজা লোকের কথা শুনে যাকে খোঁড়া হাঁস হত্যার অপরাধে বন্দীশালে আটক করেছেন, সে দেবীর ব্রতদাস। তাছাড়া খোঁড়া হাঁসকে তো কেউ মারেনি। পরদিন সকালে হংসশালে গেলেই রাজা হাঁসটিকে দেখতে পাবেন। দেবী রাজাকে আদেশ করেন, ব্রাহ্মণবালককে মুক্তি দিয়ে তাঁকে অর্ধরাজ্য ও নিজ কন্যা শকুন্তলাকে দান করতে। পরদিন সকালে হংসশালে গিয়ে রাজা সত্যই দেখেন যে হাঁসটি নৃত্য করছে। দেবীর কৃপায় প্রাণ ফিরে পেয়েছে সেটি। তখন রাজা বালককে মুক্তি দেন এবং দেবীর আদেশ মতো তাকে অর্ধরাজ্য দান করে নিজ কন্যার সহিত তার বিবাহ দেন। তারপর প্রভূত ধনরত্ন ও স্ত্রীকে নিয়ে বালক নিজের মায়ের কাছে ফিরলে ব্রাহ্মণী আশ্চর্য হয়ে যান। তখন তিনি নিজের বাড়ির আঙিনায় সুবচনীর পূজা করেন।

কবিগণ[সম্পাদনা]

দ্বিজ মাধবের ভনিতায় সুবচনীমঙ্গলের দু’টি ক্ষুদ্র পুথি পাওয়া গিয়েছে। আশুতোষ ভট্টাচার্যের মতে, এই দ্বিজ মাধব চণ্ডীমঙ্গল রচয়িতা দ্বিজ মাধব নন। কারণ দ্বিজ মাধবের নামাঙ্কিত চণ্ডীমঙ্গল পুথি আবিষ্কৃত হয়েছে চট্টগ্রাম থেকে আর সুবচনীমঙ্গলের এই পুথি দু’টির প্রচলন পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। এই ভৌগোলিক দূরত্বের নিরিখেই দুই দ্বিজ মাধব একই ব্যক্তি না হওয়াই স্বাভাবিক বলে তিনি মতপ্রকাশ করেন। তাঁর অপর যুক্তি ছিল, দ্বিতীয় পুথিটিতে দ্বিজ মাধব ভনিতার পরিবর্তে মাধব দাস ভণিতা পাওয়া যায়।

সুভদামঙ্গলের অপর একজন কবি ছিলেন দ্বিজ শ্রীরামজীবন। তিনি হুগলি জেলার আরামবাগ মহকুমার অন্তর্গত আরান্ডি গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। তাঁর লেখা ক্ষুদ্র কাব্যটিতে তাঁর বিস্তারিত আত্মপরিচয় এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামের দেবদেবীদের কথাও জানা যায়।