বিষয়বস্তুতে চলুন

ভগবদ্গীতা/৫ম অধ্যায় (সন্ন্যাসযোগ)

উইকিবই থেকে
ভগবদ্গীতা
সন্ন্যাসযোগ

পঞ্চম অধ্যায়
কর্মসন্ন্যাস-যোগ


অর্জুন উবাচ
সন্ন্যাসং কর্মণাং কৃষ্ণ পুনর্যোগং চ সংসসি।
যচ্ছ্রেয় এতয়োরেকং তন্মে ব্রুহি সুনিশ্চিতম্।।১।।
সরলার্থঃ অর্জুন বললেন- হে শ্রীকৃষ্ণ! প্রথমে তুমি আমাকে কর্ম ত্যাগ করতে বললে এবং তারপর কর্মযোগের অনুষ্ঠান করতে বললে। এই দুটির মধ্যে কোনটি অধিক কল্যাণকর, তা সুনিশ্চিতভাবে আমাকে বল।


সন্ন্যাসঃ কর্মযোগশ্চ নিঃশ্রেয়সকরাবুভৌ।
তয়োস্ত কর্মসন্ন্যাসাৎ কর্মযোগো বিশিষ্যতে।।২।।
সরলার্থঃ পরমেশ্বর ভগবান বললেন- কর্মত্যাগ কর্মযোগ উভয়ই মুক্তিদায়ক। কিন্তু, এই দুটির মধ্যে কর্মযোগ কর্ম সন্ন্যাস থেকে শ্রেয়।


জ্ঞেয়ঃ স নিত্যসন্ন্যাসী যো ন দ্বেষ্টি ন কাঙ্ক্ষতি।
নির্দ্বন্দ্বো হি মহাবাহো সুখং বন্ধাৎ প্রমুচ্যতে।।৩।।
সরলার্থঃ হে মহাবাহো! যিনি তাঁর কর্মফলের প্রতি দ্বেষ বা আকাঙ্ক্ষা করেন না, তাঁকেই নিত্য সন্নাসী বলে জানবে। এই প্রকার ব্যক্তি দ্বন্দ্বরহিত এবং পরম সুখে কর্মবন্ধন থেকে মুক্তি লাভ করেন।


সাংখ্যযোগৌ পৃথগ্ বালাঃ প্রবদন্তি ন পন্ডিতাঃ।
একমপ্যাস্থিতঃ সম্যগুভয়োর্বিন্দতে ফলম্।।৪।।
সরলার্থঃ অল্পজ্ঞ ব্যক্তিরাই কেবল সাংখ্যযোগ ও কর্মযোগকে পৃথক পৃথক পদ্ধতি বলে প্রকাশ করে, পন্ডিতেরা তা বলেন না। উভয়ের মধ্যে যে কোন একটিকে সুষ্ঠুরূপে আচরণ করলে উভয়ের ফলই লাভ হয়।


যৎ সাংখ্যৈঃ প্রাপ্যতে স্থানং তদ্ যোগৈরপি গম্যতে।
একং সাংখ্যংক চ যোগং চ যঃ পশ্যতি স পশ্যতি।।৫।।
সরলার্থঃ যিনি জানেন, সাংখ্য-যোগের দ্বারা যে গতি লাভ হয়, কর্মযোগের দ্বারাও সেই গতি প্রাপ্ত হওয়া যায় এবং যিনি সাংখ্যযোগ ও কর্ম-যোগকে এক বলে জানেন, তিনিই যথার্থ তত্ত্বদ্রষ্টা।


সন্ন্যাসস্ত মহাবাহো দুঃখমাপ্তুমযোগতঃ।
যোগযুক্তো মুনির্ব্রহ্ম ন চিরেণাধিগচ্ছতি।।৬।।
সরলার্থঃ হে মহাবাহো! কর্মযোগ ব্যতীত কেবল কর্মত্যাগরূপ সন্ন্যাস দুঃখজনক। কিন্তু যোগযুক্ত মুনি অচিরেই ব্রহ্মকে লাভ করেন।


যোগযুক্তো বিশুদ্ধাত্মা বিজিতাত্মা জিতেন্দ্রিয়ঃ।
সর্বভুতাত্মভূতাত্মা কুর্বন্নপি ন লিপ্যতে।।৭।।
সরলার্থঃ যোগযুক্ত জ্ঞানী বিশুদ্ধ বুদ্ধি, বিশুদ্ধ চিত্ত ‍ও জিতেন্দ্রিয় এবং তিনি সমস্ত জীবের অনুরাগভাজন হয়ে সমস্ত কর্ম করেও তাতে লিপ্ত হন না।


নৈব কিঞ্চিৎ করোমীতি যুক্তো মন্যেত তত্ত্ববিৎ।
পশ্যন্ শৃণ্বন্ স্পৃশন্ জিঘ্রন্নশ্নন্ গচ্ছন্ স্বপন্ শ্বসন্।।৮।।
প্রলপন্ বিসৃজন্ গৃহ্নন্নুন্মিষন্নিমিষন্নপি।
ইন্দ্রিয়াণীন্দ্রিয়ার্থেষু বর্তন্ত ইতি ধারয়ন্।।৯।।
সরলার্থঃ চিন্ময় চেতনায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তি দর্শন, শ্রবণ, স্পর্শ, ঘ্রাণ, ভোজন, গমন, নিদ্রা ও নিঃশ্বাস আদি ক্রিয়া করেও সর্বদা জানেন যে, প্রকৃতপক্ষে তিনি কিছুই করছেন না। কারণ প্রলাপ, ত্যাগ, গ্রহণ, চক্ষুর উন্মেষ ও নিমেষ করার সময় তিনি সব সময় জানেন যে, জড় ইন্দ্রিয়গুলিই কেবল ইন্দ্রিয়ের বিষয়ে প্রবৃত্ত হয়েছে, তিনি নিজে কিছুেই করছেন না।


ব্রহ্মণ্যাধায় কর্মাণি সঙ্গং ত্যক্ত্বা করোতি যঃ।
লিপ্যতে ন স পাপেন পদ্মপত্রমিবাম্ভসা।।১০।।
সরলার্থঃ যিনি সমস্ত কর্মের ফল পরমেশ্বর ভগবানকে অর্পণ করে অনাসক্ত হয়ে কর্ম করেন, কোন পাপ তাঁকে কখনও স্পর্শ করতে পারে না, ঠিক যেমন জল পদ্মপাতাকে স্পর্শ করতে পারে না।


শুচৌ দেশে প্রতিষ্ঠাপ্য স্থিরমাসনমাত্মনঃ।
নাত্যুচ্ছ্রিতং নাতিনীচং চৈলাজিনকুশোত্তরম্।।১১।।
তত্রৈকাগ্রং মনঃ কৃত্বা যতচিত্তেন্দ্রিয়ক্রিয়ঃ।
উপবিশ্যাসনে যুঞ্জ্যাদ্ যোগমাত্মবিশুদ্ধয়ে।।১২।।
সরলার্থঃ যোগ অভ্যাসের নিয়ম এই যে, কুশাসনের উপর মৃগচর্মের আসন, তার উপরে বস্ত্রাসন রেখে অত্যন্ত উচ্চ বা অত্যন্ত নীচ না করে, সেই আসন পবিত্র স্থানে স্থাপন করে তাতে আসীন হবেন। সেখানে উপবিষ্ট হয়ে চিত্ত, ইন্দ্রিয় ও ক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রিত করে চিত্ত শুদ্ধির জন্য মনকে একাগ্র করে যোগ অভ্যাস করবেন।


সমং কায়শিরোগ্রীবং ধারয়ন্নচলং স্থিরঃ।
সংপ্রেক্ষ্য নাসিকাগ্রং স্বং দিশশ্চানবলোকয়ন্।।১৩।।
প্রশান্তাত্মা বিগতভীর্ব্রহ্মচারিব্রতে স্থিতঃ।
মনঃ সংযম্য মচ্চিত্তো যুক্ত আসীত মৎপরঃ।।১৪।।
সরলার্থঃ শরীর, মস্তক ও গ্রীবাকে সমানভাবে রেখে অন্য দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ না করে, নাসিকার অগ্রভাগে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে প্রশান্তাত্মা, ভয়শুন্য ও ব্রহ্মচর্য ব্রতে স্থিত পুরুষ মনকে সমস্থ জড় বিষয় থেকে প্রত্যাহার করে, আমাকে জীবনের চরম লক্ষ্যরূপে স্থির করে হৃদয়ে আমার ধ্যানপূর্বক যোগ অভ্যাস করবেন।


যুঞ্জন্নেবং সদাত্মানং যোগী নিয়তামানসঃ।
শান্তিং নির্বাণপরমাং মৎসংস্থামধিগচ্ছতি।।১৫।।
সরলার্থঃ এভাবেই দেহ, মন ও কার্যকলাপ সংযত করার অভ্যাসের ফলে যোগীর জড় বন্ধন মুক্ত হয় এবং তিনি তখন আমার ধাম প্রাপ্ত হন।


নাত্যশ্নতস্তু যোগোহস্তি ন চৈকান্তমনশ্নতঃ।
ন চাতিস্বপ্নশীলস্য জাগ্রতো নৈব চার্জুন।।১৬।।
সরলার্থঃ অধিক ভোজনকারী, নিতান্ত অনাহারী, অধিক নিদ্রাপ্রিয় ও নিদ্রাশূন্য ব্যক্তির যোগী হওয়া সম্ভব নয়।


যুক্তাহারবিহারস্য যুক্তচেষ্টস্য কর্মসু।
যুক্তস্বপ্নাববোধস্য যোগো ভবতি দুঃখহা। ১৭।।
সরলার্থঃ যিনি পরিমিত আহার ও বিহার করেন, পরিমিত প্রয়াস করেন, যাঁর নিদ্রা ও জাগরণ নিয়মিত, তিনিই যোগ অভ্যাসের দ্বারা সমস্ত জড়-জাগতিক দুঃখের নিবৃত্তি সাধন করতে পারেন।


যদা বিনিয়তং চিত্তমাত্মন্যেবাবতিষ্ঠতে।
নিস্পৃহঃ সর্বকামেভ্যো যুক্ত ইত্যুচ্যতে তদা।।১৮।।
সরলার্থঃ যোগী যখন অনুশীলনের দ্বারা চিত্তবৃত্তির নিরোধ করেন এবং সমস্ত জড় কামনা-বাসনা থেকে মুক্ত হয়ে আত্মাতে অবস্থান করেন, তখন তিনি যোগযুক্ত হয়েছেন বলে বলা হয়।


যথা দীপো নিবাতস্থো নেঙ্গতে সোপমা স্মৃতা।
যোগিনো যতচিত্তস্য যুঞ্জতো যোগমাত্মনঃ।।১৯।।
সরলার্থঃ বায়ুশূন্য স্থানে দীপশিখা যেমন কম্পিত হয় না, চিত্তবৃত্তির নিরোধ অভ্যাসকারী যোগীর চিত্তও তেমনইভাবে অবিচলিত থাকে।


যত্রোপরম্যতে চিত্তং নিরুদ্ধং যোগসেবয়া।
যত্র চৈবাত্মনাত্মানং পশ্যন্নাত্মনি তুষ্যতি।।২০।।
সুখমাত্যন্তিকং ‍যত্তদ্ বুদ্ধিগ্রাহ্যমতীন্দ্রিয়ম্।
বেত্তি যত্র ন চৈবায়ং স্থিতশ্চলতি তত্ত্বতঃ।।২১।।
যং লব্ধা চাপরং লাভং মন্যতে নাধিকং ততঃ।
যস্মিন্ স্থিতো ন দুঃখেন গুরুণাপি বিচাল্যতে।।২২।।
তং বিদ্যাদ্দুঃখসংযোগবিয়োগং যোগসংজ্ঞিতম্।।২৩।।
সরলার্থঃ যোগ অভ্যাসের ফলে যে অবস্থায় চিত্ত সম্পূর্ণরূপে জড় বিষয় থেকে প্রত্যাহৃত হয়, সেই অবস্থাকে যোগসমাধিবলা হয়। এই অবস্থায় শুদ্ধ অন্তঃকরণ দ্বারা আত্মাকে উপলব্ধি করে যোগী আত্মাতেই পরম আনন্দ আস্বাদন করেন।সেই আনন্দময় অবস্থায় অপ্রাকৃত ইন্দ্রিয়ের দ্বারা অপ্রাকৃত সুখ অনুভূত হয়। এই পারমার্থিক চেতনায় অবস্থিত হলেযোগী আর আত্ম-তত্ত্বজ্ঞান থেকে বিচলিত হন না এবং তখন আর অন্য কোন কিছু লাভই এর থেকে অধিক বলে মনেহয় না। এই অবস্থায় স্থিত হলে চরম বিপর্যয়েও চিত্ত বিচলিত হয় না। জড় জগতের সংযোগ-জনিত সমস্ত দুঃখ-দুর্দশাথেকে এটিই হচ্ছে প্রকৃত মুক্তি।


যোহন্তঃসুখোহন্তরারামস্তথান্তর্জ্যোতিরেব যঃ।
স যোগী ব্রহ্মনির্বাণং ব্রহ্মভূতোহধিগচ্ছতি।।২৪।।
সরলার্থঃ যিনি আত্মাতেই সুখ অনুভব করেন, যিনি আত্মাতেই ক্রীড়াযুক্ত এবং আত্মাই যাঁর লক্ষ্য, তিনিই যোগী। তিনি ব্রহ্মে অবস্থিত হয়ে ব্রহ্মনির্বাণ লাভ করেন।


লভন্তে ব্রহ্মনির্বাণম্ ঋষয়ঃ ক্ষীণকল্মষাঃ।
ছিন্নদ্বৈধা যতাত্মানঃ সর্বভূতহিতে রতাঃ।।২৫।।
সরলার্থঃ সংযতচিত্ত, সমস্ত জীবের কল্যাণে রত এবং সংশয় রহিত নিষ্পাপ ঋষিগণ ব্রহ্মনির্বাণ লাভ করেন।


কামক্রোধবিমুক্তানাং যতীনাং যতচেতসাম্।
অভিতো ব্রহ্মনির্বাণং বর্ততে বিদিতাত্মনাম্।।২৬।।
সরলার্থঃ কাম-ক্রোধশূন্য, সংযতচিত্ত, আত্মতত্ত্বজ্ঞ সন্ন্যাসীরা সর্বতোভাবে অচিরেই ব্রহ্মনির্বাণ লাভ করেন।


স্পর্শান্ কৃত্বা বহির্বাহ্যাংশ্চক্ষুশ্চৈবান্তরে ভ্রুবোঃ।
প্রাণাপানৌ সমৌ কৃত্বা নাসাভ্যন্তরচারিণৌ।।২৭।।
যতেন্দ্রিয়মনোবুদ্ধির্মুনির্মোক্ষপরায়ণঃ।
বিগতেচ্ছাভয়ক্রোধো যঃ সদা মুক্ত এব সঃ।।৩৮।।
সরলার্থঃ মন থেকে বাহ্য ইন্দ্রিয়ের বিষয় প্রত্যাহার করে, ভ্রুযুগলের মধ্যে দৃষ্টি স্থির করে, নাসিকার মধ্যে বিচরণশীল প্রাণ ‍ও অপান বায়ুর উর্ধ্ব ও অধোগতি রোধ করে, ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধি সংযম করে এবং ইচ্ছা, ভয় ও ক্রোধ শূন্য হয়ে যে মুনি সর্বদা বিরাজ করেন, তিনি নিশ্চিতভাবে মুক্ত।


ভোক্তারং যজ্ঞতপসাং সর্বলোকমহেশ্বরম্।
সুহৃদং সর্বভূতানাং জ্ঞাত্বা মাং শান্তিমৃচ্ছতি।।৩৯।।
সরলার্থঃ আমাকে সমস্ত যজ্ঞ ও তপস্যার পরম ভোক্তা, সর্বলোকের মহেশ্বর এবং সমস্ত জীবের সুহৃদরূপে জেনে যোগীরাজড় জগতের দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্ত হয়ে শান্তি লাভ করেন।

*অর্জুনবিষাদযোগ *সাংখ্যযোগ *কর্মযোগ *জ্ঞানযোগ *সন্ন্যাসযোগ *ধ্যানযোগ *বিজ্ঞানযোগ *অক্ষরব্রহ্মযোগ *রাজগুহ্যযোগ *বিভূতিযোগ *বিশ্বরুপদর্শনযোগ *ভক্তিযোগ *প্রকৃতিপুরুষবিবেকযোগ *গুণত্রয়বিভাগযোগ *পুরুষোত্তমযোগ *দৈবাসুরসম্পদবিভাগযোগ *শ্রদ্ধাত্রয়বিভাগযোগ *মোক্ষযোগ