বিষয়বস্তুতে চলুন

ব্যবহারকারী:Ramendran Nath Mishra

উইকিবই থেকে

মগের মুল্লুক * (একটি ঐতিহাসিক পর্যালোচনা) রমেন্দ্র নাথ মিশ্র

        উৎসর্গ           
  * প্রিয় বাবা ও মা , এর প্রতি আমার নিবেদন।*


-রমেন্দ্র নাথ মিশ্র

দৈনন্দিন জীবনে আমরা প্রায়শই বলে ফেলি, “মগের মুল্লুক নাকি?” কিন্তু কখনও কি ভেবে দেখেছি কেন বলি আর মগের মুল্লুক দিয়েই বা কী বোঝানো হয়? যদি ভেবে না থাকি তবে কৌতুহল মেটাতে এর উৎপত্তিটা একনজর দেখেই আসা যাক।

বাংলা ব্যাকরণে “মগের মুল্লুক” একটি বাগধারা, যার অর্থ অরাজক দেশ অর্থাৎ রাজাহীন বা বিশৃঙ্খল ভূখণ্ড।

ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, বর্তমানে মায়ানমারের আরাকান নামক রাজ্যটিতেই “মগ” জাতির অবস্থান ছিল। সপ্তদশ শতাব্দীতে যখন যখন বঙ্গভূমি তথা আমাদের এ ভূখণ্ড সমৃদ্ধির এক জ্বলন্ত উদাহরণ, তখনই পর্তুগিজ এবং মগ জলদস্যুদের নজরে পড়ে বাংলার দক্ষিণাঞ্চল। উল্লেখ্য যে, তখন বাংলা ছিল আফগান ভূমি থেকে আগত মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনস্থ, তবে দিল্লীকেন্দ্রিক মুঘলরা দূর-দূরান্ত থেকে এসে জলপথে আক্রমণ করার ক্ষেত্রে ছিল অদক্ষ। অপরদিকে পর্তুগিজ বা মগ জলদস্যুরা এ পথেই ছিল পটু। ফলাফলস্বরূপ মুঘল সুবেদাররা কখনোই মগদের সাথে পেরে উঠছিলো না। আর এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেই মগেরা ইচ্ছেমতো লুটপাট, অত্যাচার আর ধ্বংসযজ্ঞ চালাতো। এমনকি তখনকার ঢাকার সুবেদাররা মগ জলদস্যুদের ভয়ে কিংবা তাদের সাথে যুদ্ধে হেরে পালিয়েও যান। এর অন্যতম উদাহরণ সুবেদার আমজাদ খান এবং খান-ই-দুরান যিনি মগ জলদস্যুদের ভয়ে পালিয়ে রাজমহলও চলে যান।ঢাকার মগবাজার জায়গাটির নামকরণের পিছনেও জড়িয়ে আছে এই মগসম্প্রদায়ের ইতিহাস।

সময়ের সাথে সাথে মগ জলদস্যুদের এই অত্যাচার যেন বাড়তেই থাকে আর বঙ্গদেশ নিমজ্জিত হতে থাকে অরাজকতায়। এমনকি মুঘল আমলের শেষেও মগদের এই যত্রতত্র নির্যাতনের ধারা অব্যাহত ছিল এবং ক্রমশ বৃহৎ পরিসরে ছড়িয়ে পড়ছিল। পুরো বাংলার পর তারা আসামেও যখন তখন আক্রমণ আর অত্যাচার শুরু করে। ১৮২৪ সালের দিকে এই অত্যাচার চরম আকার ধারণ করলে শাসক ও সাধারণ মানুষের সাথে মগ জলদস্যুদের কয়েক দফা যুদ্ধ হয়। মোটামুটিভাবে বলা যায় এই যুদ্ধগুলোই ধীরে ধীরে তাদের গতি ব্যাহত করে এবং ১৮৮৫ সালের যুদ্ধের পর মগজলদস্যুরা বেশ নিষ্ক্রিয় হয়ে আসে। ফলে প্রায় দুশো বছরেরও বেশি এক অসহনীয় নির্যাতন থেকে মুক্তি পায় বাংলার মানুষ।

মগরা যেসব স্থানে আক্রমণ করতো সেখানে লুটপাট, ধর্ষণ, শারীরিক নির্যাতন, যুবকদের বন্দী করে নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি অকথ্য অত্যাচার চালাতো। এমনকি শোনা যায় যে, দাস হিসেবে তারা যাদের নিয়ে যেতো হাত ও পায়ের তালু ছিদ্র করে বেত ঢুকিয়ে রাখা হতো, আর মুরগিদের যেভাবে চাল ছিটিয়ে খাবার দেওয়া হতো নৌকার পাটাতনে তাদের বন্দী করে রেখে একই উপায়ে খাবার দেওয়া হতো। এ তো এক ছোট্ট উদাহরণ তাদের অযাচিত ও অশোভন ব্যবহারের, এছাড়াও আরও নানান পন্থায় বাঙালিকে শোষণ করেছে তারা। এদের অত্যাচারে কিছু কিছু এলাকা মানবশূন্যও হয়ে পড়েছিল। কাজেই বাঙালির কাছে মগজাতি সদাসর্বদা বিরাজ করেছে এক আতংকের নাম হিসেবেই। আর তাই মগের মুল্লুক দিয়ে আজও আমরা যা ইচ্ছে তাই করার দেশ বা অরাজকতাকেই বোঝাই। মগ আরাকান নিবাসী জাতি বিশেষ। জাতিতত্ববিদেরা এদের ইন্দো-চীন নিবাসী বলে মনে করেন। এদের মধ্যে মারমগরি, ভূঁইয়া মগ, বড়ুয়া মগ, রাজবংশী মগ, মারমা মগ, রোয়াং মগ, ভ্যুমিয়া মগ ইত্যাদি নামে জাত বিভাগ আছে।

          এই সাতটি শ্রেণীকে মূলত তিন ভাগে ভাগ করা যায়।

• ভ্যুমিয়া • রাজবংশী • মারমা মগ মোগল সাম্রাজ্যের সঙ্গে শত্রুতার কারণে আরাকানের মগ দস্যুরা পর্তুগিজ জলদস্যুদের সঙ্গে যোগ দিয়ে তৎকালীন মোগল-শাসনাধীন বাংলায় অবাধ লুণ্ঠন, অপহরণ ও নির্বিচারে নারীদের উপর অত্যাচার চালাত।মগ দস্যুরা বাংলার উপকূল থেকে লোকজন ধরে নিয়ে তাদের কাছে বিক্রি করত। মগদের বর্বরতার সংক্ষিপ্ত বিবরণ পাওয়া যায় ড. আহমদ শরীফের লেখায়। তিনি লিখেছেন, ‘মগ জলদস্যুরা জলপথে বাঙলাদেশের ভুলুয়া, সন্দ্বীপ, সংগ্রামগড়, বিক্রমপুর, সোনারগাঁ, বাকলা, যশোর, ভূষণা ও হুগলী লুণ্ঠন করত। তারা হিন্দু-মুসলিম, নারী-পুরুষ ও বড়-ছোট-নির্বিশেষে ধরে নিয়ে যেত। হাতের তালু ফুঁড়ে বেত চালিয়ে গরু-ছাগলের মতো বেঁধে নৌকার পাটাতনে ঠাঁই দিত। এ অবহেলা ও পীড়নের পরেও যারা বেঁচে থাকত তাদেরকে ভাগ করে নিত মগে-পর্তুগীজে।বাংলায় অতীতে বিভিন্ন দেশের জলদস্যুরা আসতো চুরি ডাকাতি বা সম্পদ লুট করতে। তাদের নিয়ে অনেক গল্প কবিতা ছড়া লেখা হয়েছে। একটি ভয়ানক দস্যু আসতো মগ রাজার দেশ থেকে। এরা ছিল মূলত পর্তুগীজ নৌ-দস্যুদের রাজাকার বাহিনী। মগরা আমাদের অঞ্চলে এসে যে অরাজকতার সৃষ্টি করতো তার মাত্রা বোঝানোর জন্য বলা হতো মগের মুল্লুক অর্থাৎ যা খুশি তাই করার দেশ। অনেকের মতে মগ মানেই আরাকানী আর মগের মুল্লুক মানে আরকান রাজ্য।

      আরাকান-রাজের সৈন্যদলের মধ্যে অনেক মগ ও অবৈতনিক পর্তুগিজ সৈন্য ছিল। এরা বছরে বারোমাস লুণ্ঠন, অপহরণ ও অত্যাচার চালাত। ১৬৬৩ খ্রিষ্টাব্দে নবাব শায়েস্তা খাঁ সেনাপতি হুসেনবেগের সহায়তায় আরাকান-রাজকে সম্পূর্ণ পরাজিত করে মোগলদের হৃত-ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করেন; ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর সেনাপতি ওমেদ খাঁ ও হুসেনবেগ চট্টগ্রাম ও সন্দ্বীপ দখল করে। শায়েস্তা খাঁর এই দুর্ধর্ষ অভিযানে চট্টগ্রাম থেকে পর্তুগিজ ও মগেরা অতি ক্ষিপ্রকারিতায় পালানোর (স্থানীয়ভাবে এই ঘটনা 'মগ-ধাওনি' নামে খ্যাত ছিল) সময় ১,২২৩টি কামান ফেলে যায়, কিন্তু অধিকাংশ ধনসম্পদ ঘড়ায় করে মাটিতে পুঁতে রেখে যায় (পরবর্তীকালে, মগ-পুরোহিতরা সাঙ্কেতিক মানচিত্রের সাহায্যে গোপনে এইসব স্থানে এসে ঘড়াগুলি উঠিয়ে নিয়ে যেতেন)। এইভাবে গোটা বাংলায় "মগের মুল্লুক"-এর অবসান ঘটে।
       ইংরেজ শাসনেও পর্তুগিজ হার্মাদদের দস্যুতার কথা শোনা যেত; ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দেও কলকাতায় মগ দস্যুর ভয় ছিল জনসমাজে। ১৭৯০ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজ সরকার হাওড়ার শিবপুরে (এখনকার বোটানিক্যাল গার্ডেনের কাছে) গঙ্গার একটা বাঁধ তৈরি করে মগ ও পর্তুগিজ দস্যুদের আগমন পথ বন্ধ করে দেন।
     সেই সময়কার মগদস্যুদের হিংস্রতার বয়ান মেলে একটি গীতিকায়-

‘সোনাবালি ছেনান করে শানো বান্ধা রে ঘাটে

তাহা দেখে মগম রাজারে নাও লাগাই লো তটে রে

আমি ক্যানবা আইলাম ঘাটে।

এক ডুব দুই ডুব তিন ডুবের কালে

চুল ধরিয়া মগম রাজারে তারে উঠায় নৌকার পরে রে।’

মগদস্যুদের চরম নৃশংসতা

‘ফিরিঙ্গির দেশখান বাহে কর্ণধারে

রাত্রিতে বহিয়া যায় হার্মাদের ডরে।’ ইউরোপীয় জলদস্যু যার বেশিরভাগই ছিল পর্তুগিজ, তাদের সহযোগিতায় মগদস্যুদের দৈরাত্ম্য শুরু হয়। এই সব নির্মম, লম্পট, অত্যাচারী পর্তুগিজ ‘হার্মাদ’ নামে পরিচিত ছিল। ছোট ছোট দ্রুতগামী জলযানে চড়ে শুধু উপকূল বা সমুদ্রেই নয়, কখনো কখনো শতাধিক মাইল দূরের স্থলভূমিতে গিয়েও এই দস্যুরা উৎসব অনুষ্ঠানের সময় ব্যাপক লুটতরাজ ও অকথ্য অত্যাচার করত। নর-নারী অপহরণ করে বিভিন্ন বন্দরে বিদেশি বণিকদের কাছে বিক্রি করে দিত। সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বাংলার উপকূলীয় এলাকায় মগ ফিরিঙ্গিদের অব্যাহত দৈরাত্ম্য সমাজ জীবনে এক অভিশাপরূপে আবির্ভূত হয়। তাদের এমন ত্রাসের রাজত্বের কারণে ‘মগের মুল্লুক’ কথাটির প্রচলন। কথাটি বীভৎসতার প্রতীক। এমন ভয়ানক রাক্ষুসে আচরণের নজির ইতিহাসে বিরল।


‘মগ’ একটি অত্যন্ত পরিচিত শব্দ। ষোড়শ শতকের বঙ্গোপসাগরের ত্রাস। অতুল শক্তিশালী নৌবহর।…বীভৎস কুটিল স্বভাবের নোংরা দস্যু জাতি। শ্রী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বিভিন্ন উপন্যাসে বহু জায়গায় এই জলদস্যু গোষ্ঠীর বর্ণনা করেছেন।

তৎকালীন সাহিত্যে সমস্ত জায়গায় আমরা মগ বলতে আরাকানের মুসলিম সম্প্রদায়কেই পড়েছি। যাদেরকে আমরা রোহিঙ্গা বলে জানি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে কিছু বাংলাদেশ ভিত্তিক নিউজ পোর্টালের মাধ্যমে এই তথ্য সম্প্রচার করা হচ্ছে যে মগরা সবাই বৌদ্ধ ছিল ও রোহিঙ্গারা হল তাদের victim।

“মগদস্যুরা পর্তুগীজদিগের সঙ্গে যোগ দিয়া দেশে যে অরাজকতা সৃষ্টি করিয়াছিল তাহা অতি ভয়াবহ। তাহাদের স্পর্শদোষে অনেক ব্রাহ্মণ পরিবার এখনও পতিত হইয়া আছেন।বিক্রমপুরের মগোন-ব্রাহ্মণদের সংখ্যা নিতান্ত অল্প নহে। মগ ও পর্তুগীজদের ঔরসজাত অনেক সন্তানে এখনও বঙ্গদেশ পরিপূর্ণ। ফিরিঙ্গীদের সংখ্যা চট্টগ্রাম, খুলনা ও ২৪ পরগনার উপকূলে, নোয়াখালিতে, হাতিয়া ও সন্দ্বীপে, বরিশালে, গুণসাখালি, চাপলি, নিশানবাড়ী, মউধোবি, খাপড়াভাঙ্গা, মগপাড়া প্রভৃতি স্থানে অগণিত। ঢাকায় ফিরিঙ্গিবাজারে, তাহা ছাড়া কক্সবাজারে ও সুন্দরবনের হরিণঘাটার মোহনায় অনেক দুঃস্থ ফিরিঙ্গী বাস করিতেছে।”

পর্তুগীজ হার্মাদ,মগ জলদস্যুরা শৎগঙ [চাটিগাও, চিটাগাং], বাকলা [বরিশাল, বাকরগঞ্জ], সন্দীপ, নোয়াখালির নারী-শিশু-যুবক-বৃদ্ধ হিন্দু-মুসলিম লোকেদের ধরে বিক্রি করে। এই কেনা-বেচায় দেশীয় বণিকরাও অংশ নেয়। বর্ধমান, হুগলি, মেদিনীপুর-নবদ্বীপের সম্পন্ন পরিবারের লোকেরা অবিবাহিত পুরুষের জন্য চন্দননগরের বিবিরহাট থেকে অপহৃত দাসীদের কিনে আনে। এরকমই বর্দ্ধমান নিবাসী (উচ্চ/কূলবংশীয়) ভট্টাচার্য পরিবারে এক রূপবতী সংস্কৃত তরুণীকে কেনা হয়। বড়ছেলের সাথে বিয়েও দেয়। আত্মীয়-পরিজন উপহার নিয়ে বৌ-বরণ করতে আসে। পাছে বাঙ্গাল কথা টের পেয়ে যায়, নতুন বৌ বিশেষ রা- করে না। অদৃষ্টের এমন পরিহাস, নববধূ হঠাৎ শ্বাশুড়িকে ব’লে বসে–দেন মা, আমি কদুটা কুইটা দেই। (পূর্ববঙ্গের মুসলমান লাউকে কদু বলে)।কিন্ত ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় এনাদের মধ্যে যারা নব্য ধর্মান্তরিত মুসলিম ছিল তারাই সবচেয়ে দস্যুবৃত্তিতে অংশ নিত। এমন কি কমিউনিস্ট নেতা মুজাফফর আহমেদ পর্যন্ত তাঁর আত্মজীবনীতে তাঁর মাতুল বংশ আরাকানের ছিল একথা স্বীকার করেছেন।

মগ আসলে কারা এই প্রশ্নের উত্তর জানতে আমাদের যেতে হবে প্রাক ইসলামী দক্ষিণ পূর্ব বাঙলার ইতিহাসে। বার্মিজ ক্যালেন্ডার অনুসারে আরাকান বা রাখাইনের প্রথম রাজা হলেন খিত্তাথিন। 380 ME বা ১০১৮/১৯ তে তাঁর শাসন শুরু। ১২৭৯তে মিন হতি সিংহাসন আরোহন করেন প্রথম দিকে তিনি বর্মার Ava রাজবংশের অধীনে থাকলেও পরবর্তীতে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং একটি বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি মোট ৯৫ বছর শাসন করেন পৃথিবীর ইতিহাসে দ্বিতীয় এমন কোন রাজার উল্লেখ রয়েছে কিনা সন্দেহ রয়েছে।

১২৮৩ নাগাদ বিক্রমপুরের সেন শাসনের আর অস্তিত্ব অবলুপ্ত হয়ে যায়। সোনারগাঁ বন্দর মুসলিম অধিকারে চলে যায়। শিলালিপি ও তাম্রশাসনাদি প্রসঙ্গে দীনেশ চন্দ্র সরকার দশরথ দেবের পাকামোঢ়া তাম্রশাসনের উল্লেখ করেছেন। এখানে তিনি প্রমাণ করেছেন যে দলুজ রায় ও দশরথ দেব অভিন্ন ।

১২৯৩-৯৪ তে লখ্নৌতীতে শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ ও রুকুদ্দিন কায়াউসের মধ্যে ক্ষমতার দন্দ্ব চলছিল ।

রাজা দনুজ রায় এই দ্বন্দ্বের সুযোগে সোনারগাঁও উদ্ধারের পরিকল্পনা করেন। দিল্লি সালতানাতের অধীনতা থেকে সুবর্ণগ্রামকে মুক্ত করার জন্য, মহারাজা দনুজ রায় একটি শক্তিশালী সুলতান বিরোধী রাজনৈতিক জোট গঠনের উদ্যোগ নেন। দিল্লীর সাথে যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে তিনি প্রতিবেশী রাজ্য আরাকানের সাথে মিত্রতার সিদ্ধান্ত নেন। অবশেষে তিনি আরাকানের তৎকালীন শাসক মিন হ্তির সাথে একটি মৈত্রী স্থাপন করেন এবং দিল্লি সালতানাতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। শ্রী রজনীকান্ত চক্রবর্তীর ‘গৌড়ের ইতিহাস’ অনুসারে ১৩১৭-১৮ পর্যন্ত সোনারগাঁ দনুজ রায়ের অধিকারেই ছিল। ফিরোজ শাহর পুত্র বাহাদুর শাহ সমস্ত শক্তি একত্রিত করে সোনারগাঁ দখল করেন। এরপর দনুজ রায় সোনারগাঁ থেকে সরে গিয়ে চন্দ্রদ্বীপে তার নতুন রাজধানী স্থাপন করেন। আরাকানের যুদ্ধ: 

আরাকানের রাজা Min saw Mon গৌড়ে সামরিক সাহায্য চাইতে রান ১৪০৪ সালে । কিন্তু গণেশের ও দেব বংশের শাসনকাল কেবলমাত্র যুদ্ধে নিয়োজিত থাকায় তাঁদের থেকে সহায়তা পাননি।

একটি সমসাময়িক আরাকানীয় নথি লিপিবদ্ধ করেছে যে রাজা গণেশের সেনাবাহিনী, তৎকালীনভাবে পান্ডুয়ার নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং যুদ্ধে ইব্রাহিমকে পরাজিত করেছিল। এই নথি অনুসারে, আরাকানের একজন শাসক Min Sow Mon নামের, যিনি ১৪০৬ সালে একজন বার্মিজ রাজা মিনখাউং (আভা রাজবংশ) দ্বারা পরাজিত হয়ে পান্ডুয়ায় আশ্রয় নিয়েছিলেন, তিনি রাজা গণেশকে সামরিক সাহায্য দিয়েছিলেন যা তার সেনাবাহিনীকে ইব্রাহিমকে পরাস্ত করতে সক্ষম করেছিল।

জালালুদ্দিন ক্ষমতায় এলে তিনি তাঁর কাছেও সহায়তা চান । গণেশের ও দেব বংশের সৈন্য বাহিনীতে Min Sow বহুদিন ধরেই ছিলেন।

জালালুদ্দিন তাঁর সামরিক কুশলতার সম্বন্ধে জউনপুরের সাথে ( মুঙ্গেরের যুদ্ধে ) যুদ্ধের সময় থেকেই পরিচিত ছিলেন। তিনি সুলতানের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন এবং সুলতানকে আরাকানি সিংহাসন পুনরুদ্ধারে সাহায্য করতে রাজি করান। সুলতান রাজি হন কিন্তু এক শর্তে যে Min Sow Mon কে ইসলাম গ্রহণ করতে হবে এবং তাকে তার রাজ্যে মুসলিম সুফিদের প্রবেশের ধর্মপ্রচারের অনুমতি দিতে হবে। Min Sow Mon র রাজি হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল। জালালুদ্দিন তাকে একটি নতুন নাম দেন সুলেমান শাহ। যদিও তিনি কখনো বৌদ্ধ ধর্ম ত্যাগ করেননি তিনি তাঁর বংশের পরবর্তী রাজারা বহু বৌদ্ধ মঠ মন্দির পরে নির্মাণ করে। আরাকান রাজপরিবার দুটি নাম ব্যবহার করত, প্রথম বৌদ্ধ হিসেবে দ্বিতীয় মুসলিম হিসেবে।

১৪২৯ সালে, তিনি সুলতানের সহায়তায় আরাকানি সিংহাসন পুনরুদ্ধার করেন এবং রাজ্য শাসন করেন। ফেব্রুয়ারি/মার্চ ১৪২৯ সালে স মোন আফগান সৈন্যদের সহায়তায় আরাকান আক্রমণ করে। আক্রমণের প্রথম প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল কারণ Saw Mon র সাথে সেনাপতির বাদানুবাদ হয়েছিল (Tabaung 790 ME), জেনারেল ওয়ালী খান বন্দী হয় Saw Mon কোন ক্রমে পালিয়ে যান।

সুলতান আরেকটি প্রচেষ্টায় রাজি হলেন। দ্বিতীয় আক্রমণটি সফল হয়। ১৮ই এপ্রিল ১৪২৯ সালে Launggyet তে Saw Mon কে রাজা ঘোষণা করা হয়। জালালউদ্দিন কোন স্বাধীন শাসক ছিলেন না তিনি বহুবার চীনের মীং বংশকে উৎকোচ প্রদান করেন। চৈনিক নৌবাহিনীর সরাসরি সোনারগাঁও বন্দরের ওপর ইন্টারেস্ট ছিল কিন্তু দেব সাম্রাজ্যের শক্তিশালী নৌবাহিনীর বিরুদ্ধে তারা টিকতে পারত না। ১৪১৫ তে Zheng He সোনারগাঁও বন্দর ভ্রমণ করেন।

Zheng He সমস্ত রকম কূটনৈতিক সাহায্য প্রদান করে জালালুদ্দিনকে। পরবর্তীতে জালালুদ্দিন যথার্থই Ming সাম্রাজ্যের অধীনতা স্বীকার করেন। Admiral Ming Shi একবার ও Zheng He দুবার পান্ডুয়া ভ্রমণ করেন। জালালুদ্দিন চীনা নৌ সেনাপতিদের যথাসাধ্য উৎকোচ প্রদান করেন। যে রাজারা তাঁর অধীনতা স্বীকার করেনি সেরকম ৩০ টি রাজ্যের রাজাকে বন্দি করে Zheng He চিনে নিয়ে যায়।

তারা ১) চৈনাদের কর প্রদান ২) চিনা নৌ বণিকদের অবাধ ব্যবসার জন্য বন্দর উন্মুক্তকরণের শর্তে ছাড়া পান।

১৪২৭- ১৪৩৪ পর্যন্ত সোনারগাঁ কার্যত চৈনিক নৌঘাঁটি হিসেবেই ব্যবহৃত হতো। দঃ পূর্ব বঙ্গ দখলের পর কার্যত সেখানের হিন্দু বৌদ্ধদের নাভিশ্বাস উঠে যায় জালালুদ্দিন ও নব্য ধর্মান্তরিত আরাকানের রাজাদের অত্যাচারে।বহু হিন্দু মন্দির বৌদ্ধ মঠ ধ্বংস হয়। বহু মানুষ প্রবল অত্যাচারের মধ্য দিয়ে ধর্মান্তরিত হন।

• পূর্ববঙ্গে হিন্দু নির্যাতন শুরু হলে বহু ব্রাহ্মণ নবদ্বীপ অঞ্চলে আগমন করেন। ( গৌড়ের ইতিহাস রজনীকান্ত চক্রবর্তী)

চট্টগ্রামের পতনের কারণ ? যুদ্ধক্ষেত্রে খারাপ সিদ্ধান্ত:

দেব সাম্রাজ্যের তিনটি প্রধান বন্দর ছিল

বাকলা, চট্টগ্রাম, সোনারগাঁও। স্থলপথে ত্রিপুরার সাহায্য ছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর ধরে রাখা অসম্ভব মনে করে দনুজ মর্দান সোনারগাঁ ও চট্টগ্রাম দুটি বন্দর থেকে সৈন্যদের সরিয়ে দেন। তিনি সন্দীপ নৌ ঘাঁটিতে প্রত্যাহার করা সৈন্যদের একটি অংশ এবং মধুমতি বলেশ্বরী নদী পাহারা দেওয়ার জন্য নিযুক্ত বাকি নৌ সৈন্যদের স্থাপন করেছিলেন। এটাই ছিল সবচেয়ে বড় ভুল, চট্টগ্রাম বন্দরের নিয়ন্ত্রণ ছাড়া মেঘনা নদীর ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা সম্ভব ছিল না।

জালালউদ্দিনের সেনাপতি কদল খান গাজী চট্টগ্রাম তার সৈন্য নিয়ে কুমিল্লা দখল করেন এবং এখন পূর্ব দিক থেকেও দেব সাম্রাজ্যের আক্রমণ শুরু হয়। দেব সাম্রাজ্য উত্তরে জালালুদ্দিনের বাহিনী, পশ্চিমে খান জাহান আলী এবং পূর্বে কদল খান দ্বারা তিন দিক বেষ্টিত ছিল। প্রায় দুই বছর পর সব প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে।


দেব বংশের পতনের পর চট্টগ্রাম দখল ও হিন্দু বৌদ্ধ গণহত্যা

সপ্তদশ শতকের প্রখ্যাত কবি মুহাম্মদ খান কর্তৃক আনুমানিক ১৬৪৬ খ্রিস্টাব্দে রচিত ‘মক্তুল হোসেন’ কাব্যের শুরুতেই আমরা দেখতে পাই চট্টগ্রামের স্থানীয় মানুষদের কিভাবে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে।কদলখান গাজী তার এগারো জন বন্ধু-দরবেশের সাহায্যে চট্টগ্রামে ইসলাম প্রচার করেন।লোকশ্রুতি যে, পীর বদর শাহ্, কতল পীর এবং মহসিন আউলিয়া সম্ভবত সর্বপ্রথম একসঙ্গে চট্টগ্রামে আগমন করেন। গোলাম সাকলায়েনের লেখা ‘বাংলাদেশের সূফী-সাধক’ গ্রন্থে বারো আউলিয়ার মধ্যে দশ আউলিয়ার সংক্ষিপ্ত পরিচয় পাওয়া যায়। সংক্ষিপ্ত পরিচয় হল: 

১. সুলতান বায়েযীদ বোস্তামী

২. শেখ ফরীদ

৩. বদর শাহ্ বা বদর আউলিয়া বা পীর বদর 

৪. পীর কতল 

৫. শাহ্ মহসিন আওলিয়া

৬. শাহ্ পীর

৭.শাহ্ উমর

৮. শাহ্ বাদল

৯.শাহ্ চাঁদ আউলিয়া,

১০. শাহ্ জায়েজ

১৪২৫ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে সুফি কদল খান গাজী এগারোটি রেজিমেন্টের সহযোগিতায় স্থানীয়দের পরাজিত করে চট্টগ্রাম অধিকার করে তা সুলতান ফখরুদ্দীন মোবারক শাহের দখলদারিত্বের অন্তর্ভুক্ত করেন।

দেব বংশ খুব দ্রুত সৈন্য অপসারণ করায় চট্টগ্রাম দখল করতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি । সম্ভবত কদলখান গাজী ছিলেন জালালুদ্দিন শাহের সেনাপতি। মক্তুল হোসেন গ্রন্থে উল্লেখ আছে:

“এক মনে প্রণাম করম বারে বার।ভএ কেহ মজ্জি সমুদ্রের তল ।।

একসর মহিম হইল প্রাণহীন।

রিপুজিনি চাটি গ্রাম কৈলা নিজাধীন ।।

বৃক্ষডালে বসিলেক কাফিরের গণ।

সেই বৃক্ষ ছেদি সবে করিলা নিধন ।।

তান একাদশ মিত্র করম প্রণাম।

পুস্তক বাড়এ হেতু না লেখিলু নাম।।

তান একাদশ মিত্র জিনিয়া চাটিগ্রাম।

মুসলমান কৈলা চাটিগ্রাম অনুপাম ।।”

(ডক্টর আব্দুর করিম, ২০১৮: ১৯-২০)

অর্থাৎ চট্টগ্রাম দখলের পর সর্বত্র হত্যা লীলা চলে। যে সমস্ত কাফিররা প্রাণ রক্ষা করতে বৃক্ষে আশ্রয় নিয়েছিল তাদেরকেও হত্যা করা হয়। কতটা নির্মমতার আশ্রয় নিয়ে চট্টগ্রামকে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে, তা সেই সময়ের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাই। মগদস্যু দমন ও ঐতিহাসিক মগ ধাওনী

এই মগ ফিরিঙ্গি দস্যুদের দমন করতে ইসলাম খাঁ তার রাজধানী ঢাকায় স্থাপন করেন। পরবর্তী সময়ে ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে শায়েস্তা খাঁ এসে মগদস্যুদের সম্পূর্ণরূপে দমন করেন। মুঘল শাসকের হাতে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে তারা ক্ষিপ্রগতিতে পালিয়ে যায়। তাদের এই পলায়নই ইতিহাসে ‘মগ ধাওনী’ নামে পরিচিত। পালিয়ে যাওয়ার পর এই মগরা শতবর্ষের গৃহযুদ্ধ ও দস্যুবৃত্তিতে নিজেদের শক্তিক্ষয় করে, বর্মীদের কাছে বশ্যতা স্বীকার করে নেয়।

সেই গুপ্তধনের রহস্য

মগদের পরাজিত পলায়নের সম্পদ তারা সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেনি, বড় বড় ঘড়ায় করে তা রাতারাতি মাটিতে পুঁতে ফেলে। শুধু তাই নয়, এসব লুকিয়ে রাখা সম্পদের মানচিত্রও অঙ্কন করে রাখেন মগ পুরোহিতরা। এই মানচিত্রকে বলা  হতো ‘বিজক’। পালানোর পর পুরোহিতরা গোপনে ‘বিজক’ অনুসরণ করে গুপ্তধন তুলে নিয়ে যেত। যেহেতু মগদের কালাজাদু নিয়ে স্থানীয়দের মনে ভীতি ছিল,কেউ তাই এসব ফেলে যাওয়া সম্পদ অনুসন্ধানেও সাহসী হতো না। তবে কি এই রাতারাতি ধনবান হওয়া, স্বপ্নাদেশ পাওয়া মিথ্যে? জানা যায়, মগ পুরোহিতরা গোপনে সম্পদ তুলে নেওয়ার সময় ভিটে বা জমির মালিককে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ কিছু সম্পদ দিয়ে যেত। সেই সঙ্গে নিজেদের হৃতপ্রায় ক্ষমতা ও লোকভীতিকে জিইয়ে রাখতে নানা স্বপ্নাদেশ ও লোকভীতির কল্পিত কাহিনীর ধূম্রজাল তৈরি করে দিয়ে যেত। আর এই রহস্যাবৃত রূপকথার গল্প শুনে শুনেই বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষের মধুর শৈশব কেটেছে!

রাখাইনের সঙ্গে মগের সম্পর্ক

রাখাইনরা সুদীর্ঘকাল ধরে তাদের আবাসভূমিকে ‘রাখাইন প্রে’ নামে ডাকত। পরে ইংরেজরা দখল করে এ রাষ্ট্রকে ‘রাকান’ নামে সম্বোধন শুরু করে। এভাবে ‘রাকান’ শব্দের আগে ‘আ’ যুক্ত হয়ে তা হয়ে যায় ‘আরাকান’। রাখাইন দেশের জনগণ ‘আরাকানিজ’ নামে অভিহিত হয়। আরাকানই বর্তমান মায়ানমার।

বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্রমতে, খ্রিস্টপূর্ব ৫ থেকে ৬ হাজার বছর আগে এই অঞ্চলে নিগ্রিতা ও দ্রাবিড়িয়ান জনগোষ্ঠী বাস করত। পরে আর্য ও মঙ্গোলীয়রা এখানে বসবাস শুরু করে। এক সময় দ্রাবিড়িয়ানরা নিগ্রিতাদের এ অঞ্চল থেকে বিতাড়িত করে। দ্রাবিড়িয়ানরা আবার সভ্য আর্য ও মঙ্গোলীয়দের দ্বারা বিতাড়িত হয়। ফলে এ অঞ্চলে টিকে থাকা সভ্য আর্য জনগোষ্ঠী ও মঙ্গোলীয়দের সংমিশ্রণে এক সময় সৃষ্টি হয় রাখাইন জাতির।

সময়টি অষ্টাদশ শতাব্দীর চতুর্থ থেকে শেষ দশক পর্যন্ত। সে সময় আরাকান অঞ্চলটি ছিল ব্যাপক বিদ্রোহ, হত্যা ও ক্ষমতা দখলের দ্বন্দ্বমুখর এক বিপর্যস্ত রাজ্য। অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে নিজ আমলাদের চক্রান্তে আরাকানের তৎকালীন স্বাধীন রাজা বার্মার রাজা বোদোফায়ার কাছে যুদ্ধে পরাজিত হন। ফলে বর্মীরা আরাকান দখলে নেয়। বর্মী সেনারা সে সময় অসংখ্য আরাকানি নারী-পুরুষ গ্রেপ্তার করে স্ত্রীলোকদের বার্মায় পাঠিয়ে দেয় এবং পুরুষদের হত্যা করতে থাকে।

বর্মীরা আরাকানের মহামুনি বুদ্ধমূর্তি তাদের রাজধানী মান্দালয়ে নিয়ে যায়। এতে ক্ষোভে ফেটে পড়ে আরাকানবাসী। তারা বর্মী দখলদারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। বিদ্রোহ দমনে বর্মী বাহিনী নির্মম অত্যাচার চালায়। ফলে জীবন বাঁচাতে দেশ ছাড়ে রাখাইনরা।

১৭৮৪ সালের শীতের হিম হাওয়ায় মগ্ন এক রাত। আরাকানের মেঘবতী থেকে ১৫০টি রাখাইন পরিবার ৫০টি নৌকা নিয়ে বঙ্গোপসাগরে নৌকা ভাসায়। সাগর পাড়ি দিয়ে তিনদিন তিনরাত পর তারা আশ্রয় নেয় পটুয়াখালী জেলার রাঙ্গাবালী দ্বীপে। সে সময় ওই দ্বীপে ছিল না কোনো জনমানব। ছিল শুধু হিংস্র জন্তু-জানোয়ার।

রাখাইনরা সঙ্গে নিয়ে আসা শস্যবীজ দিয়ে ফসল রোপণ শুরু করে। তারা হিংস্র জন্তু-জানোয়ারদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে তখন বাসগৃহের চারপাশে সুন্দরী কাঠের গুঁড়ি দিয়ে ঘিরে রাখত। বড় ছেনি আর বল্লম ছাড়া তাদের কাছে কোনো অস্ত্র ছিল না। তা দিয়েই তারা কৌশলে জন্তু শিকার করে তার মাংস খেত।

এক সময় এক ইউরোপিয়ান নাবিক রাখাইনদের অবস্থান খুঁজে পান। তার মাধ্যমে অন্যদের সঙ্গেও রাখাইনদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। অফিসাররা তাদের জন্য বিশুদ্ধ পানি, ওষুধ, কাপড়-চোপড়ের ব্যবস্থা করে দেয়।

এ অঞ্চলে তখন ইংরেজ শাসন চলছে। ইংরেজরা স্বপ্ন দেখত বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা এবং আরাকান রাজ্য দখলের। তাই তারা আদিবাসী জাতিগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখত। রাখাইনরা তখন ইংরেজদের সহযোগিতায় আরাকান থেকে তাদের আত্মীয়স্বজন ও পরিচিতজনদের নিয়ে আসতে থাকে। এভাবে এদেশের মাটিতে রাখাইনদের বসতির বিস্তৃতি ঘটে। ধীরে ধীরে রাখাইনরা ছড়িয়ে পড়ে গলাচিপা, কলাপাড়া, আমতলী, বরগুনা, বানিয়াহাতী, টিয়াখালী, কুয়াকাটা, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন অঞ্চলে।

রাখাইনদের অনেকেই ‘মগ’ বলে থাকে। কিন্তু রাখাইনরা নিজেদের ‘মগ’ বলতে রাজি নয়। ফারসি শব্দ ‘মুগ’ থেকে ‘মগ’ নামের উৎপত্তি। মুগ অর্থ অগ্নি উপাসক। ধারণা করা হয় আরাকানের আদিবাসীরা জড় উপাসক ছিল। এ বিষয়ে গবেষক সতেন্দ্রনাথ ঘোষাল মনে করেন সংস্কৃত শব্দ ‘মগদু’ থেকে ‘মগ’ শব্দের উৎপত্তি। মগদু অর্থ জলদস্যু। তার মতে, আরাকানে কতিপয় লোক পর্তুগিজদের সঙ্গে একত্রিত হয়ে পূর্ব বাংলার উপকূলীয় অঞ্চলে লুটতরাজ চালাত। তাই তাদের ডাকা হতো ‘মগদু’ নামে। কালক্রমে এই মগদু বিকৃত হয়ে ‘মগ’ রূপ ধারণ করে।

এ বিষয়ে ভিন্ন মতামত দেন প্রফেসর ডি জি ই হল। তার মতে ‘মগ’ শব্দটি ‘মাঙ্গাল’ বা মঙ্গোলীয় শব্দ থেকে আসা। তিনি মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আরাকানের অধিবাসীদের চেহারাগত মিল খুঁজে পান। ডা. গ্রিয়ারসন তাকে সমর্থন করেছেন। তার মতে মগরা ইন্দোচীন জনগোষ্ঠীর একটি শাখা ছাড়া আর কিছুই নয়।

এ বিষয়ে রতন লাল চক্রবর্তী তার ‘বাংলাদেশ-বার্মা সম্পর্ক’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘মগ’ শব্দটি নিয়ে মতভেদ রয়েছে। তার মতে, আরাকানের মগরা পর্তুগিজ জলদস্যুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াত। মগরা আরাকানের স্থায়ী বাসিন্দা হলেও আরাকানের সমস্ত অধিবাসী জলদস্যু ছিল না এবং তারা সবাই মগও নন। তার রচনায় আক্রমণকারীদের মগ এবং পরে চট্টগ্রামে আগত আরাকানিদের ‘আরাকানি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আরাকানিদের মধ্যে রাখাইনরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও সে সময় আরও অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তা আরাকানে বাস করত। তথাকথিত যারা মগ বা জলদস্যু ছিল তারা রাখাইন নয় বরং অন্য কোনো ক্ষুদ্র জাতি বলে ধারণা করা হয়। এছাড়া মিয়ানমার রাজ্যে ৭টি প্রদেশের মধ্যে একটি প্রদেশের নাম রাখাইন স্টেট। এটি পূর্বে আরাকান নামে পরিচিত ছিল। সে আরাকানে তথা পুরো মিয়ানমারে মগ নামে কোনো জনগোষ্ঠী এখনো নেই এবং আগেও ছিল না। কিন্তু তবুও রাখাইন আদিবাসীদের ভাগ্য থেকে বিতাড়িত হয়নি ‘মগ’ নামক অমর্যাদাকর শব্দটি। তথ্যসূত্র –

(১) “বৃহৎ বঙ্গ” – শ্রী দীনেশ চন্দ্র সেন

(২) “‘ বাংলার দাস-বাণিজ্যের ক্রীতদাসী” – শ্রী প্রভাত রঞ্জন সরকার

(৩) শ্রী নগেন্দ্রনাথ বসু – “বিশ্বকোষ” ত্রয়োদশ খন্ড, পৃ – ৬৭৮

(৪) শ্রী দীনেশ চন্দ্র সরকার – “শিলালিপি ও তাম্রশাসনাদি প্রসঙ্গ”

(৫) শ্রী রজনীকান্ত চক্রবর্তী – “গৌঢ়ের ইতিহাস”, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ – ১৯২

(৬) Richard Maxwell Eaton (1993). “The Rise of Islam and the Bengal Frontier, 1204-1760”.pp-53ff, 54ff.

(৭) Harvey 1925: 137–140

(৮) Sandamala Linkara Vol. 2 1999:

(৯) Myint-U 2006: 73

(১০) Sandamala Linkara Vol. 1 1997:

(১১) East Africa and its Invaders p. 37

(১২) Paranavitana, History of Ceylon, p.299

((১৩) Sri Haraprasad Ray, (1997). Sino – Indian Commercial and Diplomatic Relations. The Quarterly Review of Historical Studies. Vol. 37. Calcutta: Institute of Historical Studies. p. 114

(১৪) Phayre 1967: 78

(১৫) Portugese in Bengal Campos

(১৬) Tripura Rajamala [Dhanyamanikya kanda]

(১৭) Sri DC Sen – “Regional History of Bengal – Tripura kingdom”

১৮. ডক্টর আব্দুল করিম, চট্টগ্রামে ইসলাম ও ঐতিহ্য, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা : ফেব্রুয়ারি ২০১৮

১৯. গোলাম সাকলায়েন, বাংলাদেশের সূফী-সাধক, ইসলামি ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা: জুন ১৯৯৩