বাংলা উইকিপিডিয়া সহায়িকা/উইকিপিডিয়া কী এবং কেন

উইকিবই থেকে

উইকিপিডিয়া হলো ইন্টারনেট ভিত্তিক একটি জ্ঞানকোষ, যা গড়ে উঠেছে পৃথিবীর লাখ লাখ মানুষের স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে। উইকি-প্রযুক্তিনির্ভর এ সাইটে পড়ার পাশাপাশি সম্পাদনাও করা যায়। আর এ কাজটি করার জন্য শুধুমাত্র একটি ওয়েব ব্রাউজারই যথেষ্ট, অন্য কোনো সফটওয়্যারেরও প্রয়োজন নেই। ইন্টারনেট ভিত্তিক বলেই পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে বসেই উইকিপিডিয়া পড়া বা এতে তথ্য যোগ করার কাজ করা যায়। মার্কিন প্রযুক্তি উদ্যোক্তা জিমি ওয়েলস ২০০১ সালে উইকিপিডিয়া প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথম দিকে উইকিপিডিয়াতে কেবল ইংরেজি ভাষাই ব্যবহৃত হত। কিন্তু বর্তমানে পৃথিবীর ২৯৩টিরও অধিক ভাষায় উইকিপিডিয়ার সংস্করণ রয়েছে। জিমি ওয়েলসের ইচ্ছা ছিল একটি বড়সড় অনলাইন বিশ্বকোষ তৈরি করা। তবে অন্যান্য বিশ্বকোষ ধারণার চেয়ে এটি আলাদা ছিল অন্য কারণে। এটি কোনো বেতনভোগী বিশেষজ্ঞ, সম্পাদক বা লেখক দিয়ে এই বিশ্বকোষ লেখানো হবে না, বরং এই বিশ্বকোষের লেখক হবেন তারা, যারা তা হতে চান! উইকি নামের একটি সফটওয়্যার; যা দিয়ে ওয়েবসাইটে সম্পাদনা, মোছা কিংবা পরিবর্ধন করা যায় সেটি ব্যবহার করে ওয়েলেস আর তার স্বেচ্ছাসেবী কর্মীরা গড়ে তুলেছেন এক বিশাল জ্ঞানভান্ডার যার সঙ্গে তুলনা চলে কেবল আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরির।

২০০১ সালে অনেকে এই বিষয়টিকে পাগলামি বলেছেন। আর এখন এটি এই গ্রহের সবচেয়ে বড় বিশ্বকোষ হচ্ছে উইকিপিডিয়া। উইকিপিডিয়ার ইংরেজি সংস্করণে রয়েছে ৫৪ লাখেরও বেশি বিষয়। জ্ঞানের আকার হিসেবে সব জানা জ্ঞানকে একত্র করার ঘটনা এটিই প্রথম নয়। শুরুতে বিশ্বকোষ ছিল একজন চৌকস লোকের অবদান। প্রাচীন গ্রিসে এরিস্টটল প্যাপিরাসের ওপর কলম দিয়ে নিজেই লিখে ফেললেন যত জ্ঞানের কথা। তার ৪০০ বছর পর রোমের প্লিনতি ৩৭ খণ্ডের বিশ্বকোষ সৃষ্টি করলেন, একাই। নবম দশকে চীনা গবেষক তু উ একটি বিশ্বকোষ লেখেন। এবং ১৭০০ সালে দিঁদেরো এবং তার কয়েকজন বন্ধু (ভলতেয়ার আর রুশোও ছিলেন) ২৯ বছরে সৃষ্টি করেন Encyclopédie, ou Dictionnaire Raisonné des Sciences, des Arts et des Métiers। শিল্প বিপ্লবের পর এ ধারার কিছুটা ব্যতিক্রম ঘটিয়ে নতুন একটি পদ্ধতি শুরু হয়। নতুন পদ্ধতিতে এক জায়গায় জড়ো করা হয় একদল বিদগ্ধ ব্যক্তিকে। স্কটল্যান্ডের এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা হলো এ ধারার সফল উদাহরণ। কম্পিউটারের আগমন এই তালিকায় নতুন পদ্ধতি যুক্ত করে। আর এখন ইন্টারনেট একে আরও পরিবর্তন করেছে। আজ ব্রিটানিকা বা ওয়ার্ল্ড বুক ৬০ কেজি ওজনের লাখ টাকা দামের বিশ্বকোষ বিক্রি হলেও তাদের আয়ের মূল উৎস ইন্টারনেটে গ্রাহকদের চাঁদা।

জিমি ওয়েলস নতুন একটি পদ্ধতির জন্ম দিয়েছেন যা সবার জন্য একই। একজন প্রকৃত চৌকস লোকের পরিবর্তে উইকিপিডিয়া কয়েক হাজার মোটামুটি চৌকস মানুষকে জড়ো করেছে একই কাজের জন্য। সুনির্দিষ্ট নিয়মাবলি বা চেইন অব কমান্ডের পরিবর্তে উইকিপিডিয়া গ্রহণ করেছে ‘উন্মুক্ত সোর্সকোড’ দর্শনকে। একবার মুদ্রিত হয়ে যাওয়ার পর বিশ্বকোষ মাত্রই ফসিলে পরিণত হতে শুরু করে। কিন্তু উইকি সফটওয়্যারের মাধ্যমে সারাক্ষণ সম্পাদনা, পরিবর্ধন, বর্জনের কারণে এই উইকিপিডিয়া সতত চলমান, সদা পরিবর্তনশীল এবং বিন্যামূল্যের বিশ্বকোষ। ২০০৫ সালে ভারত মহাসাগরে সুনামি হওয়ার মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে উইকিপিডিয়ানরা (উইকিপিডিয়ার লেখক-সম্পাদক) সুনামি সংক্রান্ত নানা রকম তথ্য প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু সুনামির এক মাস পরও ওয়ার্ল্ড বুক তাদের গ্রাহকদের জন্য এ সংক্রান্ত কোনো নতুন তথ্য দিতে পারেনি।

এই মডেলটি কার্যকরী হওয়ার একমাত্র কারণ সম্মিলিত উদ্যোগ নয়, বরং একই সঙ্গে দুটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি মেনে চলার ফলও। নিরপেক্ষতা হলো এর প্রথমটি। উইকিপিডিয়ানরা নিরপেক্ষভাবে সব তথ্যের সমাবেশ ঘটাতে চান। তবে দ্বিতীয় নীতিটি হলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ-আস্থা ও বিশ্বাস। ধরে নেওয়া হয়, সব লেখকই এই প্রকল্পের পক্ষে, এর ভালোর জন্য কাজ করছেন, এর বিরোধিতা করার জন্য নয়। উইকিপিডিয়া যুক্তির সর্বজনীনতা এবং একে ওপরের ভালো করার মানসিকতাকে তুলে ধরতে চায়। কেউ কেউ ভাবেন যে, যেহেতু যে কেউ লিখতে পারে, তাই উইকিপিডিয়ার তথ্য হয়তো যথাযথ নয়। এ ধারণা সত্য নয়। বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী ন্যাচার পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে উইকিপিডিয়া ব্রিটানিকার মতোই ভালো।

উইকিপিডিয়ার পাওয়ার পিরামিডের একেবারে নিচে রয়েছে নামগোত্রহীন ব্যবহারকারীরা। এদের চেনা যায় কেবল যে কম্পিউটার থেকে তারা উইকি ব্যবহার করছে তার আইপি ঠিকানা দেখে। এর ওপর রয়েছে নিবন্ধিত ব্যবহারকারীরা। এদের মধ্য থেকে কেউ কেউ চেষ্টা করেন ওপরের স্তরে উপনীত হতে-প্রশাসক। প্রশাসকরা যেকোনো ভুক্তি মুছে ফেলা, সেটিকে আটকে দেওয়া, কোনো আইপি ঠিকানাকে নিষিদ্ধ ইত্যাদি করতে সক্ষম। তাদের ওপরে রয়েছে আমলারা। তারা বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে পারে।