বিষয়বস্তুতে চলুন

নিউজিল্যান্ডের ইতিহাস/মিশনারিরা

উইকিবই থেকে

মিশনারিদের নিউজিল্যান্ডে আগমন[সম্পাদনা]

স্যামুয়েল মার্সডেন

নিউজিল্যান্ডে ধর্মপ্রচারকদের পাঠানোর প্রথম দিকের একটি সংগঠন নাম হলো চার্চ মিশনারি সোসাইটি। ১৮১৩ সালে স্যামুয়েল মার্সডেন নামে নিউজিল্যান্ডের একজন ধর্মপ্রচারক ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রথম দিকের একজন সুপরিচিত ধর্মপ্রচারক। তিনি চার্চ মিশনারি সোসাইটিকে (সিএমএস) নিউজিল্যান্ডের একটি মিশনে অর্থ সাহায্য করতে বলেন। চার্চ মিশনারি সোসাইটি বর্তমানে চার্চ মিশন সোসাইটি নামে পরিচিত। এটি হলো একটি ব্রিটিশ অ্যাংলিকান মিশন সোসাইটি যা সারা বিশ্বের খ্রিস্টানদের সাথে কাজ করে। চার্চ মিশনারি সোসাইটি ১৭৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। নিউ সাউথ ওয়েলসে যে মাওরি উপজাতিদের সাথে স্যামুয়েল মার্সডেন পূর্বে দেখা করেছিলেন তাদের আচার-ব্যবহারে তিনি মুগ্ধ হন। তিনি অনুভব করেন যে তাদের মধ্যে ধর্ম প্রচার করা দরকার। স্যামুয়েল তার সাথে বসতি স্থাপনকারীদের একটি দলকে একত্রিত করতে সফল হন। তিনি তার সাথে পেয়েছিলেন একজন শিক্ষক এবং মিশনে যোগদানকারী এক ব্যক্তিকে। তবে স্যামুয়েলকে নিউজিল্যান্ডে তার নিজস্ব জাহাজের অর্থায়ন করতে হয়েছিল।

আমলাতান্ত্রিক সমস্যার কারণে প্রথম দিকের মিশনারিরা ১৮১৪ সালে নিউজিল্যান্ডের দ্বীপ উপসাগর অর্থাৎ বে অফ আইল্যান্ডে আসেন। মিশনের দুটি প্রধান লক্ষ্য ছিল। প্রথম লক্ষ্যটি ছিল মাওরি উপজাতিদের খ্রিস্টান ধর্মান্তকরণ এবং দ্বিতীয় লক্ষ্যটি ছিল ইউরোপীয় বসতি স্থাপনকারীদের মধ্যে আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার চেষ্টা করা।

যে বছর স্যামুয়েল মার্সডেনেরা বে অফ আইল্যান্ডে আসেন সেই বছরই নিউজিল্যান্ডের প্রথম খ্রিস্টান মিশনটি স্থাপনা করা হয়েছিল। তবে সেইসময় মিশনারিরা একটি উত্তপ্ত সহিংস পরিবেশে এসেছিলেন। মাওরি উপজাতিরা বসতির অন্যান্য উপজাতিদের সাথে মাস্কেটের ব্যবসায় ব্যস্ত ছিল। মাস্কেট হলো এক ধরনের লম্বা বন্দুক যা ১৬ শতকের প্রথম দিকে একটি অস্ত্র হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিল। মিশনারিদের মধ্যেও এইসময় নিজেদের মধ্যে বিবাদ ও তর্ক শুরু হয়। নিউ সাউথ ওয়েলসের গভর্নরকে নিয়েও স্যামুয়েল সমস্যায় পড়েছিলেন। তার কারণ হলো নিউ সাউথ ওয়েলসের গভর্নর মিশনটিকে গুরুত্ব সহকারে না দেখে কিছুটা রসিকতার ছলে দেখতেন। তবে সময়ের সাথে সাথে মিশনটির আরও সফলতা অর্জন করে।

১৮১৯ সালে পাইহিয়াতে একটি নতুন চার্চ মিশন স্থাপনের জন্য কেরিকেরিতে একটি জমি কেনা হয়েছিল। রেভারেন্ড হেনরি উইলিয়ামস এই কাজের পরিচালনা করেন। উইলিয়ামস এনগা পুহি উপজাতিদের মধ্যে অত্যন্ত সম্মানিত হয়ে ওঠেন এবং বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে তাদের নিজেদের মধ্যে লড়াইয়ে মধ্যস্ততা করেন। মিশনারিদের প্রভাব মাওরি উপজাতিদের মধ্যে দাসত্ব ও নরখাদকতার অবসান ঘটায়। ১৮২৫ সালে নিউজিল্যান্ডে মাওরি উপজাতিদের মধ্যে প্রথম খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা চালু হয়।

১৮৩৪ সাল থেকে ১৮৪০ সালের মধ্যে, কাইতায়া, টেমস, ওয়াঙ্গারোয়া, ওয়াইকাতো, মমমাতা (যা ১৮৩৬-৩৭ সালে উপজাতীয় যুদ্ধের সময় পরিত্যক্ত হয়েছিল), রোটোরুয়া, তৌরাঙ্গা, মানুকাউ প্রভৃতি স্থানে চার্চ মিশন প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৪০ সালের মধ্যে ২০টিরও বেশি মিশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যার মধ্যে অনেকগুলি উত্তর দ্বীপে অবস্থিত ছিল।

মাওরি উপজাতিরা মিশনারিদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছিলেন। তারা কেবল মাত্র খ্রিস্টান ধর্ম সম্পর্কেই শিখেন নি, তারা ইউরোপীয় চাষের কৌশল এবং ব্যবসাও শিখেছিল। মাওরি উপজাতিরা মিশনারিদের কাছ থেকে কীভাবে পড়তে এবং লিখতে হয় তাও শিখেছিল। মিশনারিরাও মাওরি ভাষাকে লিখিত আকারে প্রতিলিপি করেছিলেন। অনেক মাওরি উপজাতিদের জন্য মিশনারিরাই ছিলেন ইউরোপীয়দের সাথে তাদের প্রথম যোগাযোগের মাধ্যম। তাই মিশনারিরাও মাওরিদের সাথে একটি ভাল সম্পর্ক ও প্রভাব বজায় রাখতে চেয়েছিল।

১৮৩৮ সালের একটি প্রতিবেদনে দেখা যায় যে চার্চ মিশনারি সোসাইটির মিশনগুলিতে পাঁচজন মন্ত্রী, ২০ জন ক্যাটেচিস্ট {শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্কদের প্রাথমিক খ্রিস্টান ধর্মীয় শিক্ষা দেবার জন্য শিক্ষক), একজন কৃষক, একজন সার্জন, একজন সম্পাদক, একজন প্রিন্টার, একজন কাঠের চাকা সারাবার মিস্ত্রী, একজন রাজমিস্ত্রী, দুইজন সহকারী শিক্ষক এবং দুইজন শিক্ষিকা ছিলেন।

১৮৩০ সালে উইলিয়াম ইয়েট দ্বারা মুদ্রিত কো তে কাটিহামা III এর পৃষ্ঠা ii এবং iii

মিশনগুলিতে প্রথাগতভাবে যে ব্যবস্থা থাকে সেটি হলো, মিশনারির পরিবারের জন্য একটি ঘর, একটি স্কুল কক্ষ, একটি চ্যাপেল, স্কুলের শিশুদের জন্য একটি বিশ্রাম ঘর এবং মাওরি উপজাতিদের মধ্যে যারা শিক্ষক হিসাবে প্রশিক্ষিত ছিলেন তাদের জন্য ব্যবস্থা। এছাড়া এর সঙ্গে প্রায়ই সংযুক্ত থাকত একটি খামার এবং বাগান। মিশনের প্রাঙ্গন থেকে মিশনারিরা পায়ে হেঁটে মাওরি অধ্যুষিত গ্রামের একটি অঞ্চল পরিদর্শন করতে পারত।

১৮৩০-এর দশকের গোড়ার দিকে মিশনারি উইলিয়াম ইয়েট মাওরি ভাষায় মুদ্রণ শুরু করেন। চার্চ মিশনারি সোসাইটি পরে উইলিয়াম কোলেনসো নামে একজন প্রশিক্ষিত মুদ্রাকরকে পাঠায়। একটি ছাপাখানা পাইহিয়ায় পাঠানো হয়। যার ফলে নিউজিল্যান্ডে মাওরি ভাষায় বাইবেল ছাপা শুরু হয়। ১৮৩৭ সালে মাওরি ভাষায় প্রথম সম্পূর্ণ নিউ টেস্টামেন্ট বাইবেলটি মুদ্রিত হয়। ১৮৪০ সাল নাগাদ উইলিয়াম উইলিয়ামস এবং রবার্ট মাউনসেলের প্রচেষ্টায় ওল্ড টেস্টামেন্টের বেশিরভাগ অংশ মাওরি ভাষায় অনুবাদ করা হয়। অনূদিত বাইবেলের অনেক কপি পাইহিয়ার ছাপাখানা থেকে সরাসরি বিতরণ করা হয়েছিল।

ফরাসি মিশনারি প্রচেষ্টা[সম্পাদনা]

জিন-ব্যাপটিস্ট ফ্রাঙ্কোইস পম্পালিয়ার

১৮৩০-এর দশকে ফরাসি মিশনারিরা মাওরি উপজাতিদের মধ্যে ক্যাথলিক ধর্ম প্রবর্তন করে। এই ধর্মপ্রচারে প্রধান ধর্মপ্রচারকদের মধ্যে একজন ছিলেন জিন-ব্যাপটিস্ট ফ্রাঙ্কোইস পম্পালিয়ার। পম্পালিয়ার পশ্চিম ওশেনিয়ার প্রথম ভিকার এপোস্টোলিক নিযুক্ত হন। তিনি ১৮৩৮ সালের ১০ জানুয়ারি নিউজিল্যান্ডের হোকিয়াঙ্গায় আসেন। তিনি একজন পুরোহিত, এক ভাই, সামান্য কিছু জিনিসপত্র নিয়ে এসেছিলেন কিন্তু সঙ্গে অর্থ খুব কম ছিল। দুর্ভাগ্যবশত পম্পালিয়ারের জন্য পরিস্থিতি অনকূল ছিল না। হোকিয়াঙ্গার আশেপাশের বেশিরভাগ মাওরিরা ইতিমধ্যেই মেথডিস্ট ছিল এবং সম্প্রতি আগত ক্যাথলিকদের প্রতি প্রকাশ্যে তারা বিদ্বেষী হয়ে উঠেছিল।

১৮৪০ সালের মধ্যে মিশনের সদর দফতর নিউজিল্যান্ডের সুদূর উত্তরে দ্বীপ উপসাগরের কোরোরারেকাতে স্থানান্তরিত করা হয়। অতিরিক্ত ক্যাথলিক মিশন ওয়াঙ্গারোয়া, কাইপাড়া, তৌরাঙ্গা, আকারোয়া, মাতামাতা, ওটাকি, রোটোরুয়া, রাঙ্গিয়াওহিয়া এবং ওয়াকাটানে স্থাপন করা হয়।

১৮৪০ সালে ওয়েটাঙ্গির চুক্তি স্বাক্ষরের সময় পম্পালিয়ার উপস্থিত ছিলেন। এই চুক্তিতে ধর্মের স্বাধীনতার প্রসঙ্গ উত্থাপনের জন্য তাকে ধন্যবাদ জানানো হয়।

১৮৪১ সালের একটি প্রতিবেদনে ১৬৪ জন উপজাতিকে ক্যাথলিক হিসাবে দেখানো হয়েছিল।

অনেক ধর্মপ্রচারক নিউজিল্যান্ডের উপনিবেশ স্থাপনের বিরোধিতা করেছিলেন, কারণ তারা জমি ও সম্পদের জন্য মাওরি এবং ইউরোপীয়দের মধ্যে বিরোধ এড়াতে চেয়েছিলেন। তবে ধীরে ধীরে তারা নিশ্চিত হয়েছিলেন যে এই ব্যবস্থা সর্বোত্তম হবে। ফলস্বরূপ ব্রিটিশ ক্রাউন এবং মাওরিদের মধ্যে ওয়াইটাঙ্গির চুক্তিতে অনেক মাওরি প্রধানকে স্বাক্ষর করতে রাজি করান হয়।