বিষয়বস্তুতে চলুন

নিউজিল্যান্ডের ইতিহাস/তথ্যসূত্র

উইকিবই থেকে

নিউজিল্যান্ড সরকার আজ ফিরে

নিউজিল্যান্ডের ইতিহাস: এক গভীর দৃষ্টিপাত

[সম্পাদনা]

নিউজিল্যান্ড, প্রশান্ত মহাসাগরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অবস্থিত একটি অপূর্ব দেশ, যার ইতিহাস এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এই দেশটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, মাওরি সংস্কৃতি এবং ঔপনিবেশিক ইতিহাসের মিশ্রণে একটি অনন্য পরিচিতি লাভ করেছে। এই প্রবন্ধে আমরা নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায়, মাওরি জনগণের জীবনযাত্রা, ঔপনিবেশিক শাসন, স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং সমসাময়িক প্রেক্ষাপটের ওপর আলোকপাত করবো।

প্রাক-ঔপনিবেশিক সময়কাল

[সম্পাদনা]

নিউজিল্যান্ডের প্রথম অধিবাসী মাওরি জনগণ, যাদের পূর্বপুরুষরা প্রায় ১৩০০ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব পলিনেশিয়া থেকে এসে বসতি স্থাপন করেন। এই সময়ে নিউজিল্যান্ডে কোন লিখিত ইতিহাস ছিল না, কিন্তু মাওরি জনগণ তাদের ইতিহাস এবং সংস্কৃতিকে মৌখিক ভাষায় সংরক্ষণ করেছিল। তারা প্রাকৃতিক সম্পদকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে শিখেছিল এবং কৃষি, মৎস্য ও শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করত।

মাওরি সংস্কৃতি ও সমাজ

[সম্পাদনা]

মাওরি সমাজ একটি শক্তিশালী উপজাতি কাঠামোর উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। প্রতিটি উপজাতি বা "ইউই" নিজস্ব ভূমি এবং সম্পদের উপর অধিকার রাখত এবং তাদের নেতৃত্ব ছিল নির্বাচিত প্রধান বা "রাংগাতিরা" দ্বারা পরিচালিত। মাওরি সংস্কৃতি শিল্প, সংগীত, নৃত্য এবং কারুশিল্পে সমৃদ্ধ ছিল। তাদের পাথর এবং কাঠ খোদাই করার দক্ষতা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

ইউরোপীয়দের আগমন

[সম্পাদনা]

১৭৬৯ সালে ব্রিটিশ নাবিক ক্যাপ্টেন জেমস কুক নিউজিল্যান্ডে প্রথম পা রাখেন। তার অনুসন্ধান নিউজিল্যান্ডকে ইউরোপীয় মানচিত্রে স্থান করে দেয় এবং ইউরোপীয়দের আগমনের পথ সুগম করে। পরবর্তী কয়েক দশকে, তিমি শিকারি, খ্রিস্টান মিশনারি এবং অন্যান্য ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা নিউজিল্যান্ডে বসতি স্থাপন করতে শুরু করে। তাদের আগমন মাওরি জনগণের জীবনযাত্রায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনয়ন করে।

ওয়াইতাঙ্গি চুক্তি

[সম্পাদনা]

১৮৪০ সালে নিউজিল্যান্ডে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে - ওয়াইতাঙ্গি চুক্তির স্বাক্ষর। এই চুক্তি মাওরি প্রধানদের এবং ব্রিটিশ ক্রাউনের মধ্যে একটি চুক্তি ছিল, যা নিউজিল্যান্ডকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে নিয়ে আসে। চুক্তিটির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মাওরি ভূমি এবং সম্পদের সুরক্ষা করা এবং উভয় পক্ষের মধ্যে শান্তি স্থাপন করা। তবে, চুক্তির বিভিন্ন ব্যাখ্যার কারণে পরবর্তীতে অনেক সমস্যা এবং বিরোধ সৃষ্টি হয়।

ঔপনিবেশিক শাসন এবং মাওরি যুদ্ধ

[সম্পাদনা]

ওয়াইতাঙ্গি চুক্তির পর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন স্থাপিত হয় এবং ক্রমশঃ ইউরোপীয় বসতির সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ঔপনিবেশিক শাসন এবং মাওরি ভূমি দখল সংক্রান্ত বিরোধের কারণে ১৮৪৫ থেকে ১৮৭২ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন মাওরি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধগুলি মাওরি জনগণের স্বাধীনতা এবং জমির অধিকারের জন্য সংগ্রাম ছিল।

স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং রাষ্ট্র গঠন

[সম্পাদনা]

নিউজিল্যান্ডের স্বাধীনতা সংগ্রাম ধাপে ধাপে এগিয়েছে। ১৯০৭ সালে নিউজিল্যান্ড একটি স্বায়ত্তশাসিত রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায় এবং ১৯৪৭ সালে স্ট্যাটিউট অব ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাডপশন অ্যাক্ট ১৯৪৭ এর মাধ্যমে পুরোপুরি স্বাধীনতা অর্জন করে। এই আইনের মাধ্যমে নিউজিল্যান্ড ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীন হয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

সমসাময়িক নিউজিল্যান্ড

[সম্পাদনা]

স্বাধীনতার পর থেকে নিউজিল্যান্ড সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। দেশটি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় পরিচালিত হয় এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের মাধ্যমে শাসিত হয়। বর্তমান সময়ে নিউজিল্যান্ড একটি উন্নত অর্থনীতি, উচ্চমানের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা, এবং স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশের জন্য পরিচিত।

মাওরি সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবন

[সম্পাদনা]

নিউজিল্যান্ডে মাওরি সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ১৯৭০ এবং ১৯৮০-এর দশকে মাওরি জনগণের অধিকার এবং সংস্কৃতির পুনরুদ্ধারের আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৮৭ সালে মাওরি ভাষা আইন প্রণীত হয়, যা মাওরি ভাষাকে সরকারি ভাষার মর্যাদা দেয়। এই আইনটির মাধ্যমে মাওরি ভাষার ব্যবহার বৃদ্ধি পায় এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি দপ্তরে এর প্রচলন হয়।

গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এবং তারিখ

[সম্পাদনা]

১৯৪৭ - স্ট্যাটিউট অব ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাডপশন অ্যাক্ট ১৯৪৭

[সম্পাদনা]

স্ট্যাটিউট অব ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাডপশন অ্যাক্ট ১৯৪৭ এর মাধ্যমে নিউজিল্যান্ড পুরোপুরি স্বাধীনতা অর্জন করে এবং একটি পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই আইনের মাধ্যমে নিউজিল্যান্ড ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে পৃথক হয়ে একটি স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৯৫৩ - টাঙ্গিওয়াই রেল দুর্ঘটনা

[সম্পাদনা]

১৯৫৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর রাতে টাঙ্গিওয়াই রেল দুর্ঘটনা ঘটে, যখন একটি আগ্নেয়গিরির লাহার টাঙ্গিওয়াই নদীর উপর রেল সেতুটি ধ্বংস করে দেয়। ওয়েলিংটন-অকল্যান্ড নাইট এক্সপ্রেস ট্রেনটি দ্রুত গতিতে নদীতে পড়ে যায়, যার ফলে ১৫১ জন যাত্রী নিহত হয়। এই দুর্ঘটনা নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় রেল দুর্ঘটনা হিসেবে পরিচিত।

১৯৬৭ - দশমিক মুদ্রার প্রচলন

[সম্পাদনা]

১৯৬৭ সালে নিউজিল্যান্ডে দশমিক মুদ্রা প্রবর্তিত হয়, যা পুরানো পাউন্ড, শিলিং এবং পেন্সের সিস্টেম প্রতিস্থাপন করে। ১০ জুলাই, ১৯৬৭, প্রথম দশমিক মুদ্রাগুলি চালু হয় এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনয়ন করে।

১৯৮১ - স্প্রিংবক্স রাগবি ট্যুর

[সম্পাদনা]

১৯৮১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার স্প্রিংবক্স রাগবি দলের নিউজিল্যান্ড সফর একটি বিতর্কিত ঘটনা ছিল। বর্ণবৈষম্যের (আপার্টহেইড) বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কারণে এই সফরটি ব্যাপক সহিংস বিক্ষোভের জন্ম দেয়। এই সফরের পর নিউজিল্যান্ডে রাগবি ইউনিয়নের জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়, যা ১৯৮৭ সালে অল ব্ল্যাকসের রাগবি বিশ্বকাপ জয়ের পর পুনরুদ্ধার হয়।

১৯৮৫ - রেইনবো ওয়ারিয়রের ডুবে যাওয়া

[সম্পাদনা]

১৯৮৫ সালে ফরাসি সরকারের এজেন্টরা গ্রিনপিসের জাহাজ রেইনবো ওয়ারিয়র ডুবিয়ে দেয়। এই ঘটনা নিউজিল্যান্ডের এবং আন্তর্জাতিক পরিবেশ আন্দোলনে একটি বড় প্রভাব ফেলে। ফরাসি এজেন্টদের এই কাজ একটি সন্ত্রাসী আক্রমণ হিসেবে নিন্দিত হয় এবং পরিবেশবাদী গোষ্ঠীগুলির মধ্যে নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি করে।

১৯৮৭ - মাওরি ভাষা আইন

[সম্পাদনা]

১৯৮৭ সালে প্রণীত মাওরি ভাষা আইন মাওরি ভাষাকে সরকারি ভাষার মর্যাদা দেয়। এই আইনটি নিউজিল্যান্ডে মাওরি সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবনের প্রতিক্রিয়া এবং ওয়াইতাঙ্গি ট্রাইব্যুনালের সুপারিশের ভিত্তিতে প্রণীত হয়। এই আইনের মাধ্যমে নিউজিল্যান্ডের নাগরিকরা আদালতে তে রেও মাওরি ভাষা ব্যবহার করার অধিকার পায়।


নিউজিল্যান্ডের ইতিহাস একটি জটিল এবং বহুমাত্রিক যাত্রা, যা মাওরি সংস্কৃতি, ঔপনিবেশিক শাসন, স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং আধুনিক উন্নয়নের মাধ্যমে গঠিত হয়েছে। এই দেশের ইতিহাস এবং সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক আমাদেরকে একটি সমৃদ্ধ ও গভীর বোধ প্রদান করে। নিউজিল্যান্ড আজ একটি উন্নত ও স্থিতিশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা তার অতীতের থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের পথে অগ্রসর হচ্ছে।

গ্রন্থপঞ্জি

[সম্পাদনা]

বই

  • বেটম্যান নিউজিল্যান্ড এনসাইক্লোপিডিয়া

ওয়েবসাইট