বিষয়বস্তুতে চলুন

কোয়েল পালন/কোয়েল পালন পদ্ধতি

উইকিবই থেকে

মুরগির বাচ্চার মতো কোয়েলের বাচ্চাকেও কৃত্রিম পদ্ধতিতে ব্রডিং করা দরকার হয়। কোয়েল পালনের সময়কালকে দুটো ভাগে ভাগ করা হয়। যথা: বাচ্চা পালন পর্ব ও বয়স্ক কোয়েল পর্ব।

বাচ্চা কোয়েল পালন

[সম্পাদনা]

শুন্য থেকে ৩৫ দিন পর্যন্ত বাচ্চা পালন পর্বের অন্তর্ভুক্ত তবে ১৪ দিন পর্যন্ত ব্রডিং করতে হয়। পরিবেশের তাপমাত্রার কারনে ব্রডিং পর্ব ৩ সপ্তাহ বা তারও বেশি সময় হতে পারে। একদিন বয়সের বাচ্চার জন্মের পর থেকে কৃত্রিমভাবে তাপের মাধ্যমে পালন করাকে ব্রডিং বলা হয়।

কোয়েলের বাচ্চা ব্যাটারি বা লিটার যে কোনো পদ্ধতিতেই পালন করা যায়। তবে যে পদ্ধতিতেই পালন করা হোক না কেন এদের খাঁচা যে ঘরে রাখা হবে বা লিটার পদ্ধতিতে যে ঘরে পালন করা হবে সেটি যথেষ্ট মজবুত হওয়া বাঞ্ছনীয়। ঘরটি এমনভাবে তৈরি করতে হবে যেন তাতে পর্যাপ্ত আলো বাতাস প্রবেশ করতে পারে; বৃষ্টি বাদলে যেন পানি প্রবেশ না করে; ইঁদুর বা অন্যান্য পশু-পাখি যেন উৎপাত না করে। তাছাড়া ঘরটি বয়স্ক কোয়েল বা হাঁস-মুরগির ঘর থেকে কিছুটা দূরে হওয়া বাঞ্ছনীয়। ঘরটিকে সব সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে। কোয়েলের বাচ্চার ব্রুডিং ও রিয়ারিং এর জন্য আলাদা ঘর ব্যবহার করা উচিত। তবে তা সম্ভব না হলে একই ঘরে বেড়া বা পার্টিশন দিয়ে পালন করা যেতে পারে। তবে কখনোই একই খাঁচায় বা একসঙ্গে লিটারের বিভিন্ন বয়সের কোয়েল পালন করা উচিত নয়।

সঠিক তাপমাত্রা

[সম্পাদনা]

বাচ্চাদের জীবন ধারণ ও সঠিক বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টিতে তাপমাত্রা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। পরিবেশের তাপমাত্রার সঙ্গে মিল রেখে শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা জন্মের প্রথম দিকে এদের খুবই কম থাকে। তাছাড়া এদের দেহের কোমল পালকের আচ্ছাদন ও পর্যাপ্ত তাপ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। ফলে তাপের অভাবে শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যায়। এতে অনেক বাচ্চাই মারা যায়। যেগুলো বেঁচে থাকের তাদের বৃদ্ধির হারও সঠিক হয় না। তাই বাচ্চা পালন ঘরে সঠিকভাবে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। বাচ্চা পালন ঘরের তাপমাত্রা ২১ ডিগ্রি-২২ সেলসিয়াস এ রাখতে হয়। ব্রডারের বাচ্চাদের তাপ দেয়ার বিশেষ ধরনের যন্ত্র রাখতে হয়। এরপর প্রতি তিন-চারদিন পরপর ২.৫-৩.০ সে. করে কমিয়ে তিন সপ্তাহ পর তা ঘরের তাপমাত্রায় নামিয়ে আনতে হবে। শীতকাল ছাড়া বাচ্চা পালনের পরবর্তী দুই সপ্তাহ শুধু মাত্র রাতের বেলায় তাপের ব্যবস্থা করলেই চলে।

পর্যাপ্ত আলো

[সম্পাদনা]

বাচ্চাদের বৃদ্ধিতে আলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বাচ্চাদের জনন গ্রস্থির বৃদ্ধিতে আলোর বর্ণ বেশ প্রভাব ফেলে। যেমন- মর্দা বাচ্চাদের শুক্রাশয়ের বৃদ্ধিতে লাল বর্ণের আলোর ভূমিকা নীল বর্ণের তুলনায় বেশি। তাছাড়া আলোর সাহায্যেই এরা নিজেদেরকে ব্রডার হাউজের/কেইজের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে শেখে এবং খাদ্য ও পানি পান করার প্রতি মনোযোগি হয়। দু সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত বাচ্চাদের ঘরে ২৪ ঘণ্টা আলোর ব্যবস্থা করতে হবে। তৃতীয় সপ্তাহের শেষে তা কমিয়ে দৈনিক ১২ ঘণ্টায়ই সীমাবন্ধ রাখতে হবে। তবে তাড়াতাড়ি যৌন পরিপক্ক আনতে হবে প্রথম দিন থেকে ৫-৬ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত দৈনিক ২৪ ঘণ্টা আলো জ্বেলে রাখতে হবে। ব্রয়লার ক্ষেত্রে তাড়াতাড়ি ওজন বাড়ানোর জন্য ২৫-২৮ দনি থেকে ৩৫ দিন পর্যন্ত বাজারজাত করার ৭-১০ দিন পূর্ব থেকে দৈনিক ৮ ঘণ্টা আলোতে ও ১৬ ঘণ্টা অন্ধকারে রাখতে

বায়ু চলাচল ব্যবস্থা

[সম্পাদনা]

বাচ্চা পালন ঘরে পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল ব্যবস্থা রাখতে হবে। এর মাধ্যমে গরমের দিনে ঘরের মধ্যে সৃষ্ট তাপ সহজেই বেরিয়ে যেতে পারবে। এছাড়া ঘরে পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ বায়ু ঢোকা ও ঘরে সৃষ্ট ক্ষতিকারক ঘ্যাস বের হয়ে যাওয়ার জন্য সঠিক বায়ু চলাচল ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। ব্রডিংয়ের প্রথম সপ্তাহে ঘরে বায়ু চলাচল ব্যবস্থা সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখতে হবে এবং ধীরে ধীরে তা বড়াতে হবে। ঘরের আপেক্ষিক আর্দ্রতা প্রথম তিন সপ্তাহ ৬০-৬৫% পরবর্তী দু সপ্তাহ ৫৫-৬০% এ রাখতে হবে।

বাচ্চার ঘনত্ব

[সম্পাদনা]

ঘরের ভিতরে বা ব্রডারের নির্দিষ্ট জায়গার ভিতরে মোট বাচ্চার ঘনত্বের ওপর এদের সঠিক বৃদ্ধি নির্ভর করে। তিন সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত প্রতিটি বাচ্চার জন্য ব্রডারের হোভারের নিচে ৭৫ বর্গ সে. মি. জায়গা বরাদ্ধ করতে হবে। রান এর ব্রডারের হোভারে চারদিক থেকে চিক গার্ড পর্যন্ত ফাঁকা জায়গাটুকু একই পরিমাণ জায়গা থাকবে। ৩-৫ সপ্তাহ পর্যান্ত ১৫০-১৭৫ বর্গ সে.মি. জায়গার প্রয়োজন হবে। লিটার পদ্ধতিতে প্রতিটি বাচ্চার জন্য সর্বমোট ২০০-২৫০ বর্গ সে.মি. জায়গা দিতে হবে।

খাদ্য ও পানির ব্যবস্থাপনা

[সম্পাদনা]

বাচ্চাদের জীবনের প্রথম দিকে খাদ্য ও পানির সহজ প্রাপ্যতা আরামপ্রদ পরিবেশ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যদি কোনো বাচ্চা তার ধারে কাছে খাদ্য ও পানি খুঁজে না পায়, তবে তার শরীর পর্যাপ্ত শক্তির অভাবে ঠাণ্ডা হয়ে যাবে ও না খেতে পেয়ে ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে মারা যাবে। জন্মের প্রথম সপ্তাহে বাচ্চা মৃত্যুর একটি অন্যতম প্রধান কারণ হলো পানির অভাব যেহেতু ব্রডিংয়ের উচ্চ তাপমাত্রায় বাচ্চারা সহজেই পানিশূন্যতায় ভোগে তাই এদের জন্য পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা করতে হবে।

স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ

[সম্পাদনা]

বাচ্চাদের সঠিক বৃদ্ধির জন্য ঘর ও ব্রুডারের পরিবেশ স্বাস্থ্যসম্মত হওয়া বাঞ্ছনীয়। ঘরের ভিতর কোনো ময়লা আবর্জনা থাকা চলবে না। লিটার ভেজা থাকা চলবে না। বাচ্চা পালন ঘরে পালনকারি ছাড়া অন্যদের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করতে হবে। তাছাড়া অন্যান্য পশুপাখিও যেন ঘরের আশেপাশে না আসতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কোনো বাচ্চা নখ, পা, পালক, ঠোঁট প্রভৃতিতে ময়লা জমলে তা আলতোভাবে পরিষ্কার করতে হবে। ময়লার চোখ বন্ধ হয়ে গেলে একটুকরা তুলো পানিতে ভিজিয়ে ময়লা পরিষ্কার করা উচিত।

বয়স্ক কোয়েল পালন

[সম্পাদনা]

লেয়ার খামারে পূর্ণবয়স্ক মাদী কোয়েলগুলোকে ষষ্ঠ সপ্তাহ বয়স থেকে ডিম পাড়ার ঘরে লিটার বা খাঁচা পদ্ধতিতে পালন করা হয়। ব্রিডার কোয়েলগুলোকে ব্রিডার কেইজে দেয়ার পূর্বে মর্দা ও মাদী আলাদাভাবে পালন করতে হবে। সাধারণত ৭-৮ সপ্তাহ ব্যাসের বাছাই করা মর্দা কোয়েলগুলো ব্রিডার কেইজে একসঙ্গে রাখা হয় এই লক্ষ্যে ৩/৪ সপ্তাহ বয়সে যখন পালকের রং দেখে পার্থক্য করা যাবে তখন থেকে ব্রিডার কেইজে দেয়ার পূর্ব পর্যন্ত এদের আলাদাভাবে পালন করতে হবে। তাছাড়া ব্রিডিং খাঁচায় মর্দা ও মাদী সব সময়ের জন্য একসঙ্গে রাখা যাবে না। বরং সময় মতো প্রজনন করানোর জন্য মর্দাকে ব্রিডিং খাঁচায় ঢুকানো হবে। এবং নির্দিষ্টকাল পরে আবার পৃথক করে ফেলতে হবে। ব্যাটারি বা লিটর দু পদ্ধতিতে পালন করা গেলেও কোয়েলের জন্য ব্যাটারি পদ্ধতিই সহজ, নিরাপদ, টেকসই ও স্বাস্থ্য সম্মত। তাই এ পদ্ধতিতে খামার করাই লাভজনক।

সাফল্যজনকভাবে বয়স্ক কোয়েল পালন করতে হলে খামারিদের নিম্নের বিষয়গুলো সঠিকভাবে মেনে চলতে হবে।

তাপমাত্রা

[সম্পাদনা]

বয়স্ক কোয়েলের ঘরে তাপমাত্রা ২১ ডিগ্রি-২২ ডিগ্রি সে. স্থির রাখতে হবে। অতিরিক তাপমাত্রায় ডিমের উৎপাদন মারাত্মকভাবে হ্রাস পাবে।

কোয়েলের ডিম উৎপাদন আলোর ওপর যথেষ্ট নির্ভরশীল। তাই কোয়েল থেকে পর্যাপ্ত ডিম পেতে হলে দৈনিক ১৬ ঘণ্টা আলোর ব্যবস্থা করতে হবে। এই লক্ষ্যে ষষ্ঠ সপ্তাহে ১৩ ঘণ্টা আলোর ব্যবস্থা করতে হবে। সপ্তম, অষ্টম ও নবম সপ্তাহে সপ্তাহ প্রতি এক ঘণ্টা হিসেবে বাড়তি তা যথাক্রমে ১৪.১৫, ও ১৬ ঘণ্টার বৃদ্ধি করতে হবে। নবম সপ্তাহ থেকে বাকি সময় প্রতিদিন এই ১৬ ঘণ্টা হিসেবেই আলো বরাদ্দ করতে হবে। উল্লেখ্য একটি ৪০ ওয়াটের বাল্ব দিয়ে সুনির্দিষ্ট জায়গা আলোকিত করা যায়। ডিম উৎপদনে আলোর বর্ণেরও প্রভাব রয়েছে। পর্যাপ্ত ডিম উৎপাদনে লাল বর্ণের আলো বেশি ভূমিকা রাখে।

বায়ু চলাচল ব্যবস্থা

[সম্পাদনা]

ঘরে পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল ব্যবস্থা থাকতে হবে। বড় খামারে ক্ষেত্রে বায়ু চলাচল নিয়ন্ত্রণের জন্য, ঘরের লিটার শুকানোর জন্য এক্সাস্ট পাখা লাগাতে হবে। ঘরের আপেক্ষিক আর্দ্রতা থাকতে হবে ৫৫-৬০% ।

প্রয়োজনীয় জায়গা

[সম্পাদনা]

লিটার পদ্ধতিতে প্রতিটি পাখির জন্য ২০০-২৫০ বর্গ সে.মি. জায়গার ব্যবস্থা। করতে হবে। তাছাড়া ঘরের লিটার ১০ সে.মি. পুরু হওয়া বাঞ্ছনীয়। ব্যাটারি পদ্ধতিতে খাঁচা ছোট হোক। বা বড় হোক একতলা হোক বা ছয়তলা হোক অবশ্যই প্রতিটি কোয়েলের জন্য ১৫০-২০০ বর্গ সে.মি. জায়গার ব্যবস্থা করতে হবে। উভয় পদ্ধতিতেই ব্রিডার কোয়েলের জন্য কিছুটা বেশি জায়গার প্রয়োজন হবে।

ডিম পাড়ার বাক্স

[সম্পাদনা]

লিটার পদ্ধতিতে কোয়েল পালনে একটি অসুবিধা হলো, এরা ডিম পাড়ার পর পরই অনেক সময়ই তা লিটারের ভেতরে লুকিয়ে ফেলে। তাছাড়া লিটারে পাড়া ডিমে ময়লা লেগে যায়। এতে ডিম দেখতে খারাপ লাগে। তাই লিটারে পালিত কোয়েলের ক্ষেত্রে ডিম পাড়ার বাক্স ডিম পাড়ানোর অভ্যাস করা উচিত। এ লক্ষ্যে লেয়ার হাউজে কোয়েলের সংখ্যার অনুপাতে ডিম পাড়ার বাসা বা লেয়িং নেস্ট সরবরাহ করা উচিত। প্রতি ৪-৫ টি কোয়েলের জন্য একটি লেয়িং নেস্ট সরবরাহ করা উচিত। প্রতিটি লেয়িং নেস্ট ১৫x২০ x ২০ ঘন সে.মি. মাপের হওয়া বাঞ্ছনীয়।

খাদ্য ও পানির জায়গা

[সম্পাদনা]

ব্যাটারি বা লিটার উভয় পদ্ধতিতেই প্রতিটি কোয়েলের জন্য খাদ্য ও পানির জন্য যথাক্রমে ৩ ও ২ সে.মি. জাগয়া বরাদ্দ করতে হবে। তাছাড়া বিশেষ নকশার খাদ্য ও পানির পাত্র ব্যবহার করতে হবে। এতে খাদ্য ও পানির অপচয় রোধ হবে।

স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ

[সম্পাদনা]

খামার সব সময় স্বাস্থ্যসম্মত ও জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে। এতে কোয়েল থেকে পর্যাপ্ত উৎপাদন পাওয়া যাবে।