উইকিশৈশব:রাসায়নিক মৌল/লোহা
ধাতুটি দেখতে, স্পর্শে, স্বাদে, অথবা গন্ধে কেমন লাগে?
[সম্পাদনা]লোহা দেখতে ধূসর আভাযুক্ত চকচকে এবং ধাতব। এটি কঠিন এবং ভারী। বায়ুর অক্সিজেনের সংস্পর্শে বিক্রিয়া করলে এর রঙ লালচে বাদামী হয়ে যায়। তোমরা হয়তো জানো একে মরিচা পড়া বলে। লোহা সাধারণ অবস্থায় একটি কঠিন পদার্থ। একে গলাতে গেলে অনেক তাপমাত্রার দরকার হয়। প্রায় দেড় হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এটি গলে তরল হয়ে যায়। এই তাপমাত্রা মোমবাতির শিখার উষ্ণতম অংশের চেয়েও বেশি। তাই লোহার টুকরো জোড়া দিতে এটি গলানোর জন্য প্রকৌশলীদের একটি টর্চ ব্যবহার করতে হয়। যার নাম ওয়েল্ডিং টর্চ। এই ওয়েল্ডিং টর্চ লোহা গলিয়ে দিয়ে লোহার টুকরো দুটিকে একসাথে আটকে রাখতে সাহায্য করে। লোহা গলে গেলে তার রঙ লাল হয়ে যায়। সেই সময় এটি আক্ষরিক অর্থে 'লাল গরম' লোহা।
ধাতুটি কিভাবে আবিষ্কৃত হয়েছিল?
[সম্পাদনা]লোহা প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের কাছে পরিচিত একটি ধাতু। মনে করা হয় যে, অন্তত পাঁচ হাজার বছর ধরে মানুষ লোহা ব্যবহার করে আসছে। পঞ্চাদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে আকরিক থেকে লোহা তৈরির চুল্লি উদ্ভাবিত হয়। তবে এর অনেক বছর পরে ১৮৫৫ সালে ইস্পাত তৈরির চুল্লি উদ্ভাবিত হয়েছে।
ধাতুটির নাম কোথা থেকে এসেছে?
[সম্পাদনা]আধুনিক ইংরেজি শব্দ আয়রন (iron) এসেছে পুরনো ইংরেজি শব্দ isærn থেকে, এটি আবার ইন্দো-ইউরোপীয় শব্দ থেকে এসেছে। যার অর্থ "শক্তিশালী ধাতু" বা "পবিত্র ধাতু"। প্রাচীনকালে যা কিছু শক্তিশালী তাই পবিত্র বলে বিবেচিত হতো। কিছু ভাষাবিদ মনে করেন, আকাশ থেকে উল্কাপাতে যে লোহা পড়েছিল তার ব্যবহার মানুষ প্রথম করে। তখন তারা মনে করত দেবতাদের দ্বারা ঐ লোহা পাঠানো হয়েছে। তাই "পবিত্র ধাতু" শব্দের উৎপত্তি সেখান থেকে এসেছে। কিন্তু অন্যদের মতে এটি "শক্তিশালী ধাতু" শব্দটি থেকে এসেছে কারণ লোহা ব্রোঞ্জের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। এটি লৌহ যুগের আগের থেকেই ব্যবহৃত হতো।
লোহার রাসায়নিক প্রতীক, Fe, "ফেরাম" ("ferrum") থেকে এসেছে। লোহার ল্যাটিন নাম হলো ফেরাম। বর্তমানেও লোহাযুক্ত ধাতুগুলি 'ফেরাস' ('Ferrous') ধাতু হিসাবে পরিচিত।
তুমি কি জান?
- সুপারনোভা তৈরি হওয়ার আগে বিশাল নক্ষত্রগুলিতে লোহা তৈরি হয়।
- পৃথিবীর ভূত্বকে প্রাচুর্যের দিক থেকে অ্যালুমিনিয়ামের পরে লোহা হলো দ্বিতীয় ধাতু।
- লোহার Fe2+ আয়ন রক্তের হিমোগ্লোবিনের একটি অণুতে থাকে। এটি রক্তে অক্সিজেন বহন করতে সাহায্য করে।
- পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রটি ভূগর্ভস্থ গলিত লোহার চলাচলের জন্য তৈরি হয়।
ধাতুটি কোথায় পাওয়া যায়?
[সম্পাদনা]পৃথিবীর ভূত্বকে লোহার পরিমাণ প্রায় শতকরা পাঁচ ভাগ। পৃথিবীর ভূখণ্ডের একটি বড় অংশ লোহা তৈরি করে। লোহা উল্কাপিণ্ড থেকেও আসে।
প্রকৃতিতে লোহা প্রধানত হেমাটাইট (Fe2O3) এবং ম্যাগনেটাইট (Fe3O4) খনিজগুলির ভিতরে পাওয়া যায়। এই খনিজগুলি থেকে লোহা পৃথক করার কাজটি বড় বড় শিল্প কারখানায় করা হয়। লোহার আকরিক থেকে লোহা আলাদা করার প্রক্রিয়াটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় লোহা নিষ্কাশনের জন্য লোহার আকরিকের সঙ্গে চুনাপাথর, কোক কয়লা এবং অন্যান্য উপাদান ব্যবহার করা হয়।
এর ব্যবহার কোথায়?
[সম্পাদনা]ধাতুদের মধ্যে লোহার ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। ঢালাই লোহা, পেটা লোহা, ইস্পাত, কার্বন ইস্পাত প্রভৃতি অনেক সংকর ধাতু তৈরি করতে লোহা ব্যবহৃত হয়। গাড়ি, ট্রাক, জাহাজ, ট্রেন, রেল, শিল্প কারখানার যন্ত্রাংশ, ব্রিজ, বিভিন্ন ধরণের মেশিন, স্টিলের তৈরি অনেক দরকারী জিনিস প্রভৃতি তৈরি করতে লোহা ব্যবহার করা হয়। বিশাল বাড়ী তৈরির সময় সিমেন্ট কাঠামোকে শক্তিশালী করতে লোহা দিয়ে তৈরি ইস্পাতের বিম কাজে লাগে।
লোহা হিমোগ্লোবিনের একটি অপরিহার্য অংশ, যা আমাদের লাল রক্ত কোষে অক্সিজেন বহন করে। লোহা উদ্ভিদের ক্লোরোফিল উৎপাদনেও সাহায্য করে। আয়রন সালফেট (FeSO4) যৌগ তৈরি করতে লোহা ব্যবহৃত হয়। লোহার এই যৌগটি রক্তাল্পতার চিকিৎসায় ওষুধ হিসাবে ব্যবহার করা হয়।
ধাতুটি কি বিপজ্জনক?
[সম্পাদনা]কিছু লোহা যৌগের বেশি মাত্রায় সংস্পর্শে এলে সেটি শরীরের জন্য বিপজ্জনক। আমাদের দেহের অন্ত্র খুব বেশি পরিমাণ লোহা শোষণ করতে পারে না। তাই লোহার বিষক্রিয়া তখনই ঘটে যখন খুব বেশি মাত্রায় লোহা আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। তখন আমাদের শরীরের অন্ত্রগুলি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। লোহার বড় টুকরো মাথায় পড়লে সেটিও খুব বিপজ্জনক হতে পারে।