উইকিশৈশব:মানবদেহ/চোখ
চোখ কি?
[সম্পাদনা]চোখ প্রাণীর আলোক-সংবেদনশীল অঙ্গ ও দর্শনেন্দ্রিয়, যা আমাদের কোন কিছু দেখতে সাহায্য করে। প্রাণীজগতের সবচেয়ে সরল চোখ কেবল আলোর উপস্থিতি বা অনুপস্থিতির পার্থক্য করতে পারে। উন্নত প্রাণীদের অপেক্ষাকৃত জটিল গঠনের চোখগুলো দিয়ে আকৃতি ও বর্ণ পৃথক করা যায়। এখানে আপনি চোখ সম্বন্ধে অনেক তথ্য আহরণ করতে পারবেন। কিন্তু মনে রাখা দরকার পাতাটি পেশাদারী নয় বরং একটি উপরি রূপরেখা প্রদান করবে মাত্র।
চোখের কাজ কি? (কার্যকারিতা)
[সম্পাদনা]চোখ হলো আমাদের দেহের অঙ্গ যা আলো অনুভব করতে পারে। এর মাধ্যমে আমরা আমাদের চারিদিক দেখতে পাই ও বুঝতে পারি বিভিন্ন বস্তুর অবস্থান, আকার আকৃতি একাধিক বস্তুর পারস্পরিক সম্পর্ক। আমরা দূরবর্তী বস্তু, নিকটবর্তী বস্তুর দূরত্ব পার্থক্য, তার রং এবং আকৃতি সহজেই বুঝতে পারি। চোখ কিছুটা ক্যামেরার মত কাজ করে সেখানে চোখের পরকলা বা অক্ষিকাঁচ ক্যামেরার লেন্সের মতো কাজ করে, নেত্রপল্লব বা চোখের পাতা ক্যামেরার শাটার ও রেটিনা বা অক্ষিপট ফটোগ্রাফিক ফিল্মের প্রতিস্থাপন।
চোখ কি রকম দেখতে? (আকার)
[সম্পাদনা]চোখ আকারের দিক থেকে অনেকটা বর্তুলাকার। অক্ষি গোলকের ব্যাস ২.৩ সেন্টিমিটার মত হয়ে থাকে। আমরা চোখ বলতে এই অক্ষিগোলক ছাড়াও নেত্র পল্লব এবং ভ্রুকে বুঝি, যা মুখমন্ডলের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ গঠনের অন্যতম।
চোখের অংশ গুলো কি কি? (অংশ)
[সম্পাদনা]চোখ একাধিক ভিন্ন ভিন্ন অংশে বিভক্ত। অক্ষিগোলকের সাদা অংশটিকে স্ক্লেরা বা শ্বেতমন্ডল বলা বলা হয়। মজার বিষয় এই যে একমাত্র মানুষের ক্ষেত্রে যখন আমরা চোখ খুলি এই স্ক্লেরা দেখতে পাওয়া যায় অন্য প্রাণীর ক্ষেত্রে এই সাদা অংশ বাইরে থেকে দেখতে পাওয়া যায় না। একেবারে সামনের অংশ বাদ দিয়ে চোখের বাকি অংশ এই সাদা রঙের স্ক্লেরা দ্বারা আবৃত থাকে। চোখের একদম সামনের দিকের অংশটিকে কর্নিয়া বা অচ্ছোদপটল বলা হয়। এই অংশটিকে চোখের বর্ম বলা যেতে পারে। স্বচ্ছ হওয়ার কারণে এর মাধ্যমে আলো যাতায়াত করতে পারে। এই কর্নিয়ার নিচে (ভেতর) রয়েছে আইরিশ বা কণীনিকা এবং পিউপিল বা অক্ষিকূট বা নয়নতারা। পিউপিল হলো মাঝখানের কালো বৃত্তাকার অংশ। এটি আসলে একটি গর্ত বা তারারন্ধ্র আলোকে চোখের ভেতরে প্রবেশ করতে সাহায্য করে। আইরিশ হল পিউপিলের চারদিকে থাকা রঙিন পর্দা। এটি মাংসল অংশ, যার সংকোচন ও প্রসারণের ফলে, কম বা বেশি আলোর প্রবেশ নিয়ন্ত্রিত হয়। এর পেছনেই হয়েছে লেন্স বা অক্ষিকাঁচ, যা আলোকে ফোকাস (অধিশ্রয় বা নাভিগত করানো) করে তা রেটিনা বা অক্ষিপটের উপর ফেলে। এটি জেলির মত পদার্থ দ্বারা নির্মিত এবং আকারে উভতল উত্তল। লেন্স এবং কর্নিয়ার মাঝে রয়েছে অ্যাকুয়াস হিউমর বা অক্ষিস্নেহ নামে তরল। একইরকম ভাবে লেন্সের পিছনে অক্ষিগোলকের বেশিরভাগ অংশ জুড়ে রয়েছে ভিট্রিয়াস হিউমর বা অক্ষিরস।
রেটিনা হল চোখের পিছন দিকে ভেতর দিকের প্রান্ত। এই অংশে আমরা যা দেখতে পাই বা আমাদের চোখের ভেতর যাই আলো পতিত হয় তা মস্তিষ্কের ভাষা তথা ইলেকট্রিক ইমপালস বাস তরঙ্গ স্পন্দনে ভাষান্তর হয়। রেটিনার প্রান্ত বরাবর রয়েছে হাজার হাজার ছোট ছোট রড এবং কোন কোষ, যা আলোর উজ্জ্বলতা বিচারে তার রং এবং পরিমাণ বুঝতে পারে।
রড এবং কোন কোষের মাধ্যমে আহরিত আলোকীয় তথ্য চোখের পিছন দিকে থাকা অপটিক নার্ভ বা দর্শন স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কে গিয়ে পৌঁছায়।
রেটিনা এবং স্ক্লেরার মাঝে রক্ত সমৃদ্ধ কালো রঙের অংশটিকে কোরয়েড কৃষ্ণমন্ডল বলা হয়, এর অপটিক নার্ভ সংলগ্ন অঞ্চলকে বলা হয় ব্লাইন্ড পয়েন্ট বা অন্ধবিন্দু।
সিংহভাগ প্রতিফলন হয় কর্নিয়া অ্যাকুয়াস হিউমর এবং ভিট্রিয়াস হিউমরের মাধ্যমে আর লেন্সের কাজ প্রতিবিম্ব রেটিনায় ফোকাস করা। সিলিয়ারি পেশী এর মাধ্যমে লেন্স চোখের সামনের দিকে আটকে থাকে। এই বেশি কার্যকারিতার জন্য লেন্সের পুরুত্ব পরিবর্তন হয় এবং আমরা সামনের বস্তু ও দূরের বস্তু পৃথক করতে পারি।
শ্বেতমন্ডল
[সম্পাদনা]এটা চোখের আচ্ছাদনকারী সাদা অংশ। এটা চোখে বহীরাবরকের পেছনের দিকের ৫/৬ অংশ স্থান জুড়ে অবস্থিত। এটা ও ভিতরের তরল পদার্থগুলো (অ্যাকুয়াস হিউমার ও ভিট্রিয়াস হিউমার) মিলে চোখের সূক্ষ্ম অংশগুলোকে রক্ষা করে। এটি সাদা ও অস্বচ্ছ এবং সাদা বর্ণের কোলাজেন তন্তু দ্বারা গঠিত যার ভিতরে আলো প্রবেশ করতে পারে না।
কর্নিয়া
[সম্পাদনা]এটা গম্ভুজ আকারের স্বচ্ছ পর্দা যা চোখের সামনের অংশ ঢেকে রাখে। এটি চোখে বহীরাবরকের সামনের দিকের ১/৬ অংশ স্থান জুড়ে অবস্থিত। এটা স্বচ্ছ, কারণ এতে কোন রক্তজালিকা নেই। চোখ প্রতিস্থাপন বলতে আসলে কর্নিয়ার প্রতিস্থাপন বুঝায়।
অ্যাকুয়াস হিউমার
[সম্পাদনা]এটা জলীয় পদার্থের মত তরল পদার্থ যা সিলিয়ারি বডি থেকে উৎপন্ন হয়। চোখের সামনের অংশ (লেন্স এবং কর্নিয়ার মধ্যবর্তী অংশ) এই তরলে পূর্ণ থাকে।
কণীনিকা
[সম্পাদনা]এটা চেখের রঙিন অংশ যা অনেকটা আংটির মত। এটা বিভিন্ন রঙের হয়। যেমন- বাদামি, সবুজ, নীল ইত্যাদি। আলোর তীব্রতার উপর নির্ভর করে আইরিশ সংকোচিত বা প্রসারিত হয়। এতে পিউপিলের আকার পরিবর্তিত হয় এবং লেন্স ও রেটিনায় আপতিত আলোর পরিমাণ নিয়ন্ত্রিত হয়। এছাড়াও দুই ধরনের অনৈচ্ছিক পেশি দিয়ে আইরিশ গঠিত।
পিউপিল
[সম্পাদনা]এটা হল আইরিশের মাঝের খোলা অংশ যেখান দিয়ে আলো লেন্সে প্রবেশ করে। এটার আকার আইরিশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। তারারন্ধ্রের মধ্য দিয়ে আলো চোখের ভিতরে প্রবেশ করে।
লেন্স
[সম্পাদনা]রেটিনার উপর আলোক রশ্মি কেন্দ্রীভূত করে। এতে রক্ত সরবরাহ নেই। এর আকার সিলীয় পেশী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এটি ক্রিস্টালাইন প্রোটিন দিয়ে তৈরি। এটা আইরিশের মাংসপেশি দ্বারা সঙ্কুচিত ও প্রসারিত হতে পারে। এর ফলে আমরা সহজেই কাছের ও দূরের জিনিস দেখতে পাই। (উল্লেখ্য যে কাছের জিনিস দেখতে আমাদের চোখের লেন্স প্রসারিত হয় এবং দূরের জিনিস দেখতে আমাদের চোখের লেন্স সঙ্কুচিত হয়। )
ভিট্রেয়াস হিউমার
[সম্পাদনা]এটা জেলির মত পদার্থ যা চোখের বেশিরভাগ অংশ পূর্ণ করে রাখে (লেন্সের পিছন থেকে রেটিনা পর্যন্ত)।
কোরয়েড
[সম্পাদনা]এই স্ক্লেরা ও রেটিনার মধ্যবর্তী রক্তবাহিকাসমৃদ্ধ ও মেলানিন রঞ্জকে রঞ্জিত স্তর। মেলানিন রঞ্জক থাকায় এটি কালো দেখায়। এটা রেটিনাতে রক্ত সরবরাহ করে এবং রেটিনা হতে আগত অতিরিক্ত আলো শোষণ করে নেয়। এর ভিতরে রয়েছে আইরিশ ও লেন্স। এটি একটি ঘন রন্জিত পদার্থের স্তর।
রেটিনা
[সম্পাদনা]এটা হল চোখের আলোক সংবেদী অংশ। এটা আলোকরশ্মিকে তড়িৎ সংকেতে রূপান্তর করে দর্শন স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কে পাঠায়। রেটিনায় দুই ধরনের আলোকসংবেদী কোষ থাকে। এরা হল – রডকোষ এবং কোন্কোষ। রডকোষ আবছা বা মৃদু আলোতে দেখতে সাহায্য করে, আর কোন্কোষ স্বভাবিক বা উজ্জ্বল আলোতে দেখতে সাহায্য করে। কোন্কোষ থাকার জন্য আমরা বিভিন্ন রং চিনতে পারি এবং তাদের মধ্যে পার্থক্য করতে পারি। অর্থাৎ আমাদের রঙিন বস্তু দর্শনে কোন্কোষগুলো দায়ী।
ফোবিয়া
[সম্পাদনা]রেটিনার মাঝামাঝি এবং অন্ধবিন্দুর কাছাকাছি একটি খাঁজ দেখা যায়। এটাই ফোবিয়া। এখানে প্রচুর কোন্কোষ থাকে কিন্তু কোন রডকোষ থাকে না। আমাদের দর্শনানুভূতির বেশিরভাগই এর উপর নির্ভর করে।
অন্ধবিন্দু
[সম্পাদনা]এটি দর্শন স্নায়ুর প্রান্তবিন্দু। এখানে কোন আলোকসংবেদী কোষ (রড ও কোন্) থাকে না।
দর্শন স্নায়ু
[সম্পাদনা]এটা মানুষের দ্বিতীয় করোটিক স্নায়ু। এর মাধ্যমে চোখ থেকে আলোকসংবেদ মস্তিষ্কে পৌছায়।
চোখ কীভাবে শরীরের অন্যান্য অংশের সাথে যোগাযোগ করে? (অন্যান্য অঙ্গের সঙ্গে সংযোগ)
[সম্পাদনা]মস্তিষ্ক প্রথমে মূল তথ্য অর্থাৎ যা আমি দেখলাম তা চোখ থেকে সংগ্রহ করে, তারপর তা পারিপার্শ্বিক সম্পর্কে আমার কতটা জ্ঞান আছে সেই অনুযায়ী আমার বোধগম্য করে তোলে। মস্তিষ্ক আমি যেই জিনিসটা দেখলাম তার ব্যাখ্যা করে। কেউ সরাসরি ভাবে "দেখা"র কাজ করতে পারবেনা।
এর একটি সহজ উদাহরণ বোঝা যাবে যখন কেউ চোখের সামনে এমন কোন চশমা পড়বে যাক সামনে দেখা বস্তু কে উল্টে দেবে বা নিচের দিক ওপরে, উপর দিক নিচে করে দেবে। কিছুক্ষণ পর মস্তিষ্ক নিজে থেকেই ওই দর্শন কে পুনরায় উল্টে দেবে কারণ ওই নির্দিষ্ট চশমা বাইরে চারদিকে দৃশ্য সাথে আমার চোখে আগত আলোক তথ্য সামঞ্জস্যপূর্ণ করার দরকার আছে।
একইভাবে মস্তিষ্ক রং এবং আলোর তীব্রতা নিজের মত সংশোধন করে নেয় এবং আমাদেরকে সামনের বস্তুটিকে ভালোভাবে বুঝতে সুবিধা করে।
বাম চোখ এবং ডান চোখ থেকে আগত সামান্য ভিন্ন দৃশ্যকেও মস্তিষ্ক একত্রিত করতে সক্ষম। এর ফলে আমরা যেমন পুরনো দৃশ্য দেখতে পাই সেরকমই আমার সাপেক্ষে বস্তুর দূরত্ব বুঝতে পারি। আমাদের ডান চোখ সামনের বস্তুর চোখের সাপেক্ষে ডানদিকের দৃশ্য বেশি দেখতে পায় এবং বাম চোখ বামদিকের দৃশ্য বেশি দেখতে পায়। এই দৃশ্যকে বলা হয় স্টিরিওস্কোপিক ভিশন। এইরকম আমাদেরকে বস্তুর দূরত্ব সঠিকভাবে পরিমাপ করতে সাহায্য করে যা পারিপার্শ্বিক ত্রিমাত্রিক চিত্র অঙ্কনের সহায়ক। বস্তুর আমার সাপেক্ষে যত দূরে যাবে উভয় নেত্র দৃষ্টি তত উপরিপাতিত হবে।
দৃষ্টি সমন্বয়ে মস্তিষ্কের উপলব্ধি সব সময় নির্ভুল হয় না মাঝে মাঝে আমরা দৃষ্টি বিপথগামী হই। সেই দৃষ্টিকে অপটিক্যাল ইলিউশন বা দৃষ্টি বিভ্রম বলা হয়।
তবে মস্তিষ্কের কার্যকারিতা সিংহভাগ ক্ষেত্রে সঠিক উপলব্ধি করায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা সেই দৃষ্টি বিভ্রম কাটিয়ে উঠতে পারি। কেবলমাত্র দৃষ্টি বিভ্রমই আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে উপলব্ধি এবং সত্যিকারের অবস্থার মধ্যে কিছু হলেও পার্থক্য রয়েছে। আমাদের চোখ এবং চোখ সম্বন্ধীয় মস্তিষ্কের জটিল ক্রিয়া-কলাপ না থাকলে আমরা দেখা, লেখা, ছবি আঁকা, ছবি তোলা বা কোনো কিছুই বুঝতে পারতাম না।
চোখের সাথে আর কোন কোন অঙ্গতন্ত্র যুক্ত?
[সম্পাদনা]অপটিক নার্ভ বা স্নায়ু চোখকে মস্তিষ্কের সঙ্গে যুক্ত করে। চোখে চারিদিকে রয়েছে একাধিক চক্ষু পেশী যেমন চারটি রেকটাস পেশী এবং দুটি অব্লিক পেশী। এই পেশীগুলি অক্ষিগোলককে করোটির সঙ্গের যুক্তরাজ্যে এবং চোখের চলন নিয়ন্ত্রণ করে।
চোখকে কিভাবে অক্ষীণ রাখা যাবে?
[সম্পাদনা]আমাদের নিজেদের চোখে হাত দেওয়া বা চোখের সংস্পর্শে অন্য কোন বস্তু আনা থেকে বিরত থাকতে হবে। কোন কনস্ট্রাক্টিভ কাজ বা এমন কোনো কাজ যার ফলে চোখের ক্ষতি হতে পারে তা কম করার জন্য বিশেষ ধরনের চশমা (গগোলস) পরতে হবে। দীর্ঘক্ষন টিভির সামনে বসে থাকা যাবে না বা ল্যাপটপ কম্পিউটার বেশি ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে। বই পড়ার সময় বই এবং চোখের দূরত্ব অন্তত ২৫ সেন্টিমিটার হতে হবে। কোন অতিরিক্ত উজ্জ্বল বস্তুর (যেমন সূর্য) দিকে ইশিখন তাকানো যাবে না, এর ফলে চোখের ক্ষতি হয় এমনকি অন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও থাকে।