উইকিশৈশব:বাদ্যযন্ত্র/হারমোনিয়াম

উইকিবই থেকে
হারমোনিয়াম বাদনরত ভারতীয় গায়ক

হারমোনিয়াম এক ধরনের বিদেশী বাদ্যযন্ত্র। হারমোনিয়ামের চাবি ধরে হাওয়া প্রবাহ এবং ধ্বনি সৃষ্টির মাধ্যমে হারমোনিয়ামের সুর বের হয়। এর উদ্ভব পাশ্চাত্যে হলেও কালক্রমে যন্ত্রটি প্রাচ্যের যন্ত্রতালিকায় বিশেষ স্থান করে নেয়। এ বাদ্যযন্ত্রটি ‘ক্যাবিনেট অর্গ্যান’ নামেও পরিচিত। [১][২]

হারমোনিয়াম কেমন দেখতে?[সম্পাদনা]

হারমোনিয়াম দেখতে একটি চৌকা বাক্সের মতো। বেলোর সাহায্যে ভেতরে বায়ু চালিয়ে যন্ত্রটিকে বাজাতে হয়। এতে একটি রিডের বোর্ড থাকে এবং ধাতব রিডগুলি বোর্ডে সাতটি সুরের অন্তর্গত পৃথক শব্দ তৈরীর জায়গা অনুযায়ী ক্রমোচ্চ পদ্ধতিতে সাজানো থাকে। বেলোর সাহায্যে চালিত বায়ু ভেতরে গিয়ে রিডে আঘাত করে এবং তা থেকে ধ্বনি সৃষ্টি হয়। রিডগুলির উপরে থাকে সাদা ও কালো রঙের পর্দা। সাদা পর্দাগুলি সাধারণত শুদ্ধ স্বর এবং কালোগুলি কোমল স্বর বোঝায়। উপর থেকে এই সাদা কালো পর্দা গুলিকেই দেখা যায় এবং বাজানোর সময় এগুলিকে আলতো চেপে ধ্বনি তৈরি হয়। তবে স্কেল পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য নয়।[১][৩]

হারমোনিয়ামের আবিষ্কারক কে?[সম্পাদনা]

ইউরোপের প্যারিসে ১৮৪২ সালে আলেকজান্ডার ডেবিয়ান এটি আবিষ্কার করেন।[১] হারমোনিয়াম ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ভারতে আসে সম্ভবত ধর্মপ্রচারক এবং ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে।[৪] তারপর থেকে হারমোনিয়াম এর পরিচিতি বাড়তে থাকে। বর্তমানে ভারত পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন ধরনের গানে হারমোনিয়াম একটি গুরুত্বপূর্ণ বাদ্য।

হারমোনিয়াম কত ধরনের[সম্পাদনা]

হারমোনিয়াম সাধারণত দুই প্রকার-

১) টেবিল হারমোনিয়াম - এই প্রকার হারমোনিয়াম আকারে বড়। টেবল হারমোনিয়ামের ভেতরে হাপর লাগানো এবং ফিতা দ্বারা দুটি পাদানির সাথে যুক্ত থাকে। সেলাই মেশিনের মত দু'পায়ে হাপর দিতে হয়। এই হারমোনিয়ামে সাড়ে তিন হতে পাঁচ অক্টেভ পর্যন্ত রীড ও সেই হিসেবে পর্দা বা চাবি থাকে। সমবেত যন্ত্রসঙ্গীতে ও কোরাস গানে এবং নাট্যগীতাদির আবহ সঙ্গীত ইত্যাদিতে ব্যবহার করা হয়।

২) বক্স হারমোনিয়াম - এই জাতীয় হারমোনিয়াম সাধারণত কণ্ঠসঙ্গীত সাধনায় এবং মাহফিলাদিতে ব্যবহার করা হয়। বক্স হারমোনিয়াম সাধারণত "সি থেকে সি" হিসেবে তিন অক্টেভ বিশিষ্ট হয়ে থাকে। বক্স হারমোনিয়াম সাধারণত দুই প্রকার। যথা - ক) সিঙ্গেল রীড হারমোনিয়াম ও খ) ডাবল রীড হারমোনিয়াম।

ক) সিঙ্গেল হারমোনিয়ামে এক সারি রিড থাকে। এ ধরণের যন্ত্র সাধারণত শাস্ত্রীয় সংগীতে সহযোগী বাদ্যযন্ত্র হিসাবে তানপুরা বা সেতারের সাথে ব্যবহার করা হয়।

খ) ডাবল রীড হারমোনিয়ামে দুই সারির অধিক রীড থেকে থাকে। এ ধরণের যন্ত্র কণ্ঠ সংগীতে বেশি ব্যবহার করা হয়।

এটি কীভাবে বাজানো?[সম্পাদনা]

হারমোনিয়াম প্রথম অবস্থায় ডায়াটোনিক স্কেল-এ তৈরি করে পাশ্চাত্যে ব্যবহৃত হতো। কিন্তু এই যন্ত্রের চাবিগুলিতে পরিবর্তনের কোনো সুযোগ ছিল না বলে নির্দিষ্ট চাবিতে সুর মেলাতে অসুবিধা হতো। এতে শিল্পীর পক্ষে ভিন্ন পর্দায় সঙ্গীত পরিবেশন করা সম্ভব হতো না। পরে এই অসুবিধা দূর করার জন্য ডায়াটোনিক স্কেল পরিবর্তন করে যন্ত্রটিকে সমান স্বরান্তর (ইকুয়ালিটি টেম্পারড স্কেল)-এ রূপান্তরিত করা হয়। ফলে যেকোনো চাবিকে ইচ্ছেমতো ‘সা’ করে সঙ্গীত পরিবেশন করা সহজ হয়ে যায়।

হারমোনিয়ামের চাবিগুলি একটি নির্দিষ্ট স্কেলে বাঁধা থাকায় সঙ্গীত পরিবেশনের সময় নতুন করে সুর বাঁধতে হয় না। এতে হারমোনিয়ামে কণ্ঠশীলন সহজ হয় এবং সম্ভবত এ কারণেই হারমোনিয়াম এ দেশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বর্তমানে এ দেশের কণ্ঠসঙ্গীতে হারমোনিয়াম একটি অপরিহার্য ও বহুল ব্যবহৃত যন্ত্র। এ দেশে বিভিন্ন ধরনের হারমোনিয়াম ব্যবহৃত হয়, যথা: কপলার হারমোনিয়াম, বক্স হারমোনিয়াম, স্কেল চেঞ্জ হারমোনিয়াম, সিঙ্গল বেলো হারমোনিয়াম, ডবল বেলো হারমোনিয়াম ও সাতপাট হারমোনিয়াম।[১]

ভারতবর্ষে হারমনিয়াম[সম্পাদনা]

ভরতবর্ষে প্রথম হারমোনিয়াম সম্ভবত ব্যবহৃত হয় কলকাতায়। উনিশ শতকের ষাটের দশকে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর জোড়াসাঁকোতে স্থাপিত সখের থিয়েটারে প্রথম হারমোনিয়াম বাজান। বাঙালিদের মধ্যে প্রথমে কৌতূহল এবং পরে আগ্রহ সৃষ্টি হওয়ায় হারমোনিয়াম শিক্ষা ও তার ব্যবহার ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য উপযুক্ত গ্রন্থও রচিত হয়। শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের হারমোনিয়াম সূত্র (১৮৭৪) এবং কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায়ের হারমোনিয়াম শিক্ষা (১৮৯৯) এ বিষয়ে প্রথম ও প্রধান দুটি গ্রন্থ। গ্রন্থ দুটিতে হারমোনিয়াম বাদন সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা আছে।[১]এখনো বহু ক্ষেত্রে গান-বাজনার হাতে খড়ি হয় হারমোনিয়ামের রিড এর মাধ্যমে। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে স্বর্গীয় যোগেশ চন্দ্র বিশ্বাস তৎকালীন হারমোনিয়ামের সামান্য পরিবর্তন করেন এবং এটিকে অল্প জায়গায় সংকুচিত করে রাখার বৈশিষ্ট্য সংযোজন করেন।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. ১.০ ১.১ ১.২ ১.৩ ১.৪ "হারমোনিয়াম - বাংলাপিডিয়া"bn.banglapedia.org। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-২৮ 
  2. "Ei Samay Gold: Best Bengali Radio | Play Bengali Radio News Online | বাঙ্গালী রেডিও"eisamay.indiatimes.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-২৮ 
  3. "Ei Samay Gold: Best Bengali Radio | Play Bengali Radio News Online | বাঙ্গালী রেডিও"eisamay.indiatimes.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-২৮ 
  4. "Small encyclopedia with Indian instruments"india-instruments.comexcerpt of Suneera Kasliwal, Classical Musical Instruments, Delhi 2001