উইকিশৈশব:বাদ্যযন্ত্র/তবলা

উইকিবই থেকে
বায়া-তবলা

তবলা এক ধরনের দুই অংশ বিশিষ্ট চামড়ার তৈরি ঘাতবাদ্য যন্ত্র। দুই অংশের মধ্যে ডান হাতে বাজাবার অংশটির নাম ডাহিনা (ডাইনা, ডাঁয়া) বা তবলা এবং বাঁ হাতে বাজাবার অংশটির নাম বাঁয়া বা ডুগি। তবলার বিশেষত্ব এর জটিল আঙ্গুলের ঘাত, উন্নত বোল। তবলা বাদক শিল্পীকে বলা হয় তবলিয়াতবলচি শব্দটি আগে একই অর্থে প্রচলিত ছিল, কিন্তু বাইজীগান বা খেমটা নাচের সঙ্গতকারীদের জন্য বেশি ব্যবহৃত হওয়ায় অনেকে একে অশ্রদ্ধাজনক বলে মনে করেন, তাই তবলচির বদলে তবলিয়া শব্দটির চল হয়।

ইতিহাস[সম্পাদনা]

ঢোল এবং তালবাদ্যের বৈদিক যুগের গ্রন্থে উল্লেখ আছে। দুটি বা তিনটি ছোট ড্রাম সহ একটি পারকিউশন বাদ্যযন্ত্র, যার মধ্যে পুঁশকার (পুষ্কলা বানানও বলা হয়) পঞ্চাশ শতাব্দীর পূর্বে ভারতীয় উপমহাদেশে ছিল। এই ড্রামগুলি মৃদং-এর মতো ছিল, কিন্তু এগুলিকে তখন তবলা বলা হতো না। অজন্তা গুহাগুলির প্রাক-পঞ্চম শতাব্দীর চিত্রগুলিতে একদল সঙ্গীতশিল্পীকে ছোট তবলার মতো দেখতে ড্রাম, একটি কেটলি-আকৃতির মৃদং ড্রাম এবং করতাল বাজাতে দেখা যায়৷ উপবিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞদের সাথে ড্রাম বাজানোর অনুরূপ শিল্পকর্ম কিন্তু পাথরে খোদাই করা ইলোরা গুহা এবং অন্যান্য গুহাচিত্রগুলিতেও পাওয়া যায়।

উৎপত্তি[সম্পাদনা]

২০০ খ্রিস্টপূর্ব ভাস্কর্য ভাজে গুহা, মহারাষ্ট্র, ভারত তবলা বাদন এবং সম্পাদন ও অন্য নর্তকী মহিলা

তবলার জন্ম সম্বন্ধে নানা মতবাদ আছে। একটি হল আমীর খস্রু সম্বন্ধে। মৃদঙ্গ জাতীয় কোন দুইদিক চামড়ায় ছাওয়া যন্ত্র ভেঙে দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়, কিন্ত তার পরেও তা থেকে সুন্দর অওয়াজ বের হয়। শুনে মুগ্ধ খস্রু বলেন "তব ভি বোলা"। তবলা শব্দটি "তব ভি বোলা" থেকে এসে থাকতে পারে।

তবলার বিভিন্ন অংশ[সম্পাদনা]

এক খণ্ড কাঠ ওপর থকে কুঁদে বাটির মত করা। তার উপর চামড়া টানটান করে বসান। তাকে ঘিরে গোল ছেদযুক্ত আরেকটি চামড়া দিয়ে কিনারা বা কানি। চামড়া পেঁচিয়ে প্রস্তুত পাগড়ী এদের ধরে রেখেছে। মাঝখানে কালো গাব (গাবগাছের আঠায় কাঠকয়লা মিশিয়ে) বা স্যাহী। কিনারা ও গাবের মধ্যে উন্মুক্ত পাতলা প্রথম চামড়া হল "সুর"। উপরের পাগড়িকে টেনে রাখার জন্য নিচে দ্বিতীয় চামড়ার পাগড়ি। দুটি পাগড়ি "ছট" দিয়ে বাঁধা। ছটের টান কমবেশি করার জন্য ছটে গোঁজা কাঠের "গুলি"। নিম গাছ থেকে ভাল তবলা হয় যা সহজে ঘূণে নষ্ট হয় না। দুই খণ্ডের তবলা-বাঁয়ার সেটের একটি অংশ। সাধারণত এই অংশটি বাম হাতে বাজানো হয় বলে, একে বাঁয়া বলা হয়। কিছু কিছু বাদক এই অংশটি ডান হাতেও বাজিয়ে থাকেন। তবলার ছাউনির মধ্যস্থলে যে গোলাকার কালো অংশ থাকে, তাকে খিরন বলা হয়। গাবগাছের আঠার সাথে কাঠকয়লা মিশিয়ে আঠালো লেই তৈরি করে, উক্ত লেই দিয়ে কয়েকটি পর্যায়ে প্রলেপ দেওয়া হয়। তবলার খিরন এবং প্রান্তদেশীয় কানি অংশের ভিতরে যে বৃত্তাকার অংশ দেখা যায়, তাকে ময়দান বলে। তবলার মূল চামড়া এবং কানির চামড়াকে একত্রিত করে কাঠের উপরে বসানো হয়। পরে চামড়ার ফিতা দিয়ে তৈরিকৃত বিনুনি তবলার কানি ও মূল চামড়ার সাথে যুক্ত করে, চামড়ার দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়। এই বিনুনি অংশকে পাগড়ি বলা হয়।[১]

আনুসঙ্গিক সরঞ্জাম[সম্পাদনা]

ডুগি ও তবলার সঙ্গে ব্যবহৃত কয়েকটি আনুসঙ্গিক সরঞ্জাম হল: ১) বিড়ি/বিড়ে- যার উপর একএকটি ডুগি বা তবলাকে বসানো হয়।

২) হাতুড়ি - সুর বাঁধার জন্য।

৩) পাউডার: অনেকে হাতে পাউডার' লাগান ঘাম থেকে তবলাকে রক্ষা করার জন্য (গমক বাজাতেও পাউডারের পিচ্ছিলতা সাহায্য করে)।

৪) তবলার ঢাকা- বাতাসের আর্দ্রতা থেকে তবলাকে রক্ষা করার জন্য।

৫) নগমা রাখার জন্য সারেঙ্গী কিম্বা হারমোনিয়াম।

ঘরাণা[সম্পাদনা]

আগে তবলা সারেঙ্গীর মত প্রধানত বাইজীগানের সঙ্গতে ব্যবহার হত। তবে উত্তর ভারতে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তবলা ধীরে ধীরে এক শ্রদ্ধার আসন লাভ করে। এতে পাঁচটি ঘরাণার ওস্তাদদের মূল্যবান ভূমিকা আছে:

লক্ষ্ণৌ ঘরাণা

এলাহাবাদ ঘরাণা

দিল্লি ঘরাণা

অজরাড়া ঘরাণা

ফারুখাবাদ (পাঞ্জাব) ঘরাণা

বেনারস ঘরানা

কয়েকজন বিখ্যাত তবলিয়া:

পণ্ডিত রাম সহায় (বেনারস ঘরানার প্রতিষ্ঠাতা)

উস্তাদ সিদ্দার খান (ফারুখাবাদ ঘরাণার)

হাজী বিলায়েত খান (ফারুখাবাদ ঘরাণার প্রতিষ্ঠাতা)

উস্তাদ মুনির খান (ফারুখাবাদ ঘরাণা)

উস্তাদ আহম্মদজান থেরাকুয়া (ফারুখাবাদ ঘরাণা)

পণ্ডিত কণ্ঠে মহারাজ (বেনারস ঘরানা)

পণ্ডিত শামতা প্রসাদ (বেনারস ঘরানা)

পণ্ডিত আনোখেলাল মিশ্রা (বেনারস ঘরানা)

উস্তাদ কেরামতুল্লা খাঁ

উস্তাদ নিসার হুসেন খাঁ

পণ্ডিত কিষণ মহারাজ (বেনারস ঘরানা)

উস্তাদ আল্লারাখা (পাঞ্জাব ঘরানা)

পণ্ডিত সারদা সহায় (বেনারস ঘরানা)

পণ্ডিত বিশ্বনাথ বোস (বেনারস ঘরানা)

পণ্ডিত কুমার বোস (বেনারস ঘরানা)

পণ্ডিত পুরান মহারাজ (বেনারস ঘরানা)

উস্তাদ জাকীর হুসেন (পাঞ্জাব ঘরানা)

পণ্ডিত যোগেশ সামসী (পাঞ্জাব ঘরানা)

তবলা ডেমো

প্রসার[সম্পাদনা]

ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, আফগানিস্তান এবং শ্রীলঙ্কায় জনপ্রিয় এবং লোকসঙ্গীত পরিবেশনায়ও তবলা প্রায়শই বাজানো হয়। হিন্দু ও শিখ ধর্মের ভক্তি ভক্তির ঐতিহ্য যেমন ভজন ও কীর্তন গাওয়ার সময়ও তবলা একটি গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র। এটি সুফি সঙ্গীতশিল্পীদের দ্বারা ব্যবহৃত একটি প্রধান কাওয়ালি যন্ত্র। তবলা কত্থকের মতো নৃত্যের সাথেও পরিবেশন হয়।

বাংলার তবলা[সম্পাদনা]

বাংলায় তবলা ঐতিহ্য অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিক। কলকাতার হিরু গাঙ্গুলী ও জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ বাংলায় তবলাকে জনপ্রিয় করেন। জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ ছিলেন ফারুখাবাদ ঘরাণার মসিত খাঁ সাহেবের শিষ্য।

বাংলার আধুনিক তবলিয়াদের মধ্যে কয়েকজন বিশিষ্ট বক্তিত্ব হলেন:

শঙ্কর ঘোষ (জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের প্রধান শিষ্য)

পণ্ডিত কুমার বোস (বেনারস ঘরানার সুপ্রসিদ্ধ তবলা বাদক সংগীত আচার্য্য পণ্ডিত বিশ্বনাথ বোস এবং রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রাপ্ত সেতার বাদক বিদুষী ভারতী বোসের সুযোগ্য জ্যেষ্ঠ পুত্র এবং বেনারস ঘরানার পণ্ডিত কিষাণ মহারাজজীর সুযোগ্য শিষ্য। পণ্ডিত বিশ্বনাথ বোস বেনারস ঘরানার পণ্ডিত কন্ঠে মহারাজজীর শিষ্য ছিলেন। পিতা এবং পুত্রের মিলিত প্রয়াসে বেনারস ঘরের বাজ বাংলায় প্রচার ও সমৃদ্ধ হয়েছে। পণ্ডিত কুমার বোস বর্তমানে বেনারস ঘরানার অন্যতম শ্রেষ্ঠ তবলা বাদক।)

অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় (পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের শিষ্য)

বিক্রম ঘোষ (শঙ্কর ঘোষের পুত্র)

বাদনকালে তবলা ও বাঁয়াকে কাপড়ের বেড়ের উপর বসানো হয়। বাদক বসে বা দাঁড়িয়ে বাদ্য পরিবেশন করেন। বাজাবার পূর্বে একে উত্তমরূপে সুরে বেঁধে নিতে হয়। তবলার বোল রেলা, কায়দা, গৎ, আড়ি, কুআড়ি, গৎপরণ প্রভৃতি নামে পরিচিত। তবলাবাদনের বিভিন্ন ঘরানা আছে। তন্মধ্যে দুটি বাংলা ঘরানার নাম বিষ্ণুপুর ঘরানা ও ঢাকা ঘরানা। [সমবারু চন্দ্র মহন্ত] [২]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. তবলার ইতিবৃত্ত। শম্ভুনাথ ঘোষ। আদি নাথ ব্রাদার্স। পৌষ ১৪১৭।
  2. http://bn.banglapedia.org/index.php?title=তবলা