উইকিশৈশব:অনুবাদ গল্প/তিন স্কুলবন্ধু
![](http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/thumb/7/71/Omar_the_Tentmaker_%281922%29_1.jpg/220px-Omar_the_Tentmaker_%281922%29_1.jpg)
সেই প্রাচীন একাদশ শতাব্দীর কথা, প্রাচ্যের এক রাতে, যখন আকাশের ক্ষীণ আলো নিশাপুর শহরের শাদিয়াখ জেলার একটি মায়খানার (একটি সরাইখানা) উপর আভা ছড়াচ্ছিল, মদ্য পরিবেশিকা সাকি তার প্রেমিক ওমরের জন্য শেষবারের মতো অপেক্ষা করছিল। ওমর এবং তার দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু, নিজাম এবং হাসান পরদিন সকালে নিশাপুর বিদ্যালয় থেকে উত্তীর্ণ হতে চলেছিল।
![](http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/thumb/f/f8/027-myself-when-young-did-frequent--Doctor-and-saint-q75-780x1170.jpg/160px-027-myself-when-young-did-frequent--Doctor-and-saint-q75-780x1170.jpg)
নিজাম তুস শহরে জন্মগ্রহণ করেছিল। সে ছিল সুলতান মাসৌদের অর্থ বিষয়ক একজন কর্মকর্তার ছেলে। সে একদম ছোটবেলাতেই নিশাপুর বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে এসেছিল, আসার পরেই ওমর এবং হাসানের সাথে তার বন্ধুত্ব হয়ে যায়। এরা দুজন ইমাম মুয়াফ্ফাকের সবচেয়ে বুদ্ধিমান ছাত্র ছিল, আর ইমাম ছিলেন এই বিদ্যালয়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য শিক্ষক। নিজাম তার স্মৃতিকথায় লিখেছে "যেদিন আমি বিদ্যালয়ে যেতাম না, সেদিন আমি আমার বন্ধুদের কাছে পড়া বুঝে নিতাম"।
হাসানের জন্ম হয়েছিল রায় শহরে। গোপনভাবে, তার বাবা -মা, নিপীড়িত ইসমাইলি সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
সেই রাতে, সেই সরাইখানায় তাদের শেষ আসরে, হাসান ইমাম মুয়াফ্ফাক সম্পর্কে সকলের জানা একটি কথা নিজাম ও ওমরকে বলল: ইমাম মুয়াফ্ফাকের অনেক ছাত্রই জীবনে খুব সফল পুরুষ হয়ে উঠেছে, এদের মধ্যে অনেকেই পারস্যের রাজ দরবারে উচ্চ পদে পৌঁছে গেছে। হাসান বলল যে তাদের তিনজনের মধ্যে একজন অন্তত অবশ্যই খুব উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন পদে কাজ করবে। "এসো আমরা প্রতিজ্ঞা করি যে, এই সৌভাগ্য যার কাছেই আসুক না কেন, সে তাকে বাকিদের সঙ্গে সমানভাবে ভাগ করে নেবে এবং নিজের জন্য কোন অগ্রাধিকার রাখবে না।"। বাকি দুজন হাসানের কথায় রাজি হল। সেই রাতে এই চুক্তি করার পর, তারা পান করল এবং অনেক আনন্দ করল, তারা জানত যে তারা সবাই শেষ পর্যন্ত উচ্চ পদে প্রতিষ্ঠিত হবে!
পরের দিনের সকাল এসে গেল, এবং প্রতিটি ছাত্র তার জীবন নিয়ে কি করতে চায় সে সম্বন্ধে ভাবনা চিন্তা শুরু করল।
![]() |
![]() |
ওমর সাকিকে বিয়ে করেছিলেন, এবং পরবর্তী জীবনে একজন বিখ্যাত পণ্ডিত ও কবি হয়ে উঠেছিলেন |
ওমর ঠিক করলেন তিনি তার প্রিয়া সাকির সাথে নিশাপুরেই থাকবেন। অবশেষে তিনি একজন মহান পণ্ডিত হয়ে উঠেছিলেন। গণিতশাস্ত্রে তিনি ওই অঞ্চলের সকল গণিতবিদদের ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। তিনি কিছুদিনের মধ্যেই জ্যোতির্বিদ্যায় এবং তার সময়ের অন্যান্য সমস্ত ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। তার ভালবাসার কবিতা, রুবাইয়াত, খুব বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল।
![](http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/thumb/4/48/The_Mud_Walls_of_Nishapur_%2C_Khorassan_s._XIX.jpg/220px-The_Mud_Walls_of_Nishapur_%2C_Khorassan_s._XIX.jpg)
হাসান নিশাপুর ছেড়ে তার নিজ শহর রায়ের উদ্দেশ্যে গেলেন। সেখানে, তিনি তার বাবার চেয়েও বেশি সফল হয়েছিলেন, এই অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মধ্যে যারা গোপনে ইসমাইলি ছিল তাদের মধ্যে অনেক বন্ধু এবং মিত্রদের তিনি একত্র করেছিলেন। মিশর ভ্রমণ করে, তিনি সেখানকার ইসমাইলি সম্প্রদায়ের নেতাদের সাথে দেখা করেছিলেন।
নিজাম তার বাবার সাথে সুলতান মাসৌদের জন্য কাজ করা শুরু করলেন। বাবার মৃত্যুর পর তিনি তার স্থলাভিষিক্ত হলেন, এবং কিছুদিনের মধ্যেই তিনি তার বিশেষ যোগ্যতা প্রমাণ করে দিলেন। সুলতান মাসৌদ মারা গেলে বিদ্রোহ দেখা দিল। নিজাম তার একজন বন্ধু, একজন দক্ষ সামরিক নেতা, আল্প আরসলানকে অন্যান্য রাজকুমারদের পরাজিত করে রাজা হতে সহায়তা করলেন। সুলতান হয়ে আল্প আরসলান শেষ পর্যন্ত নিজামকে সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ পদে উজির হিসেবে নিয়োগ দিলেন।
উজির হওয়ার পর, নিজামের তার ছোটবেলার চুক্তির কথা মনে পড়ে গেল। তিনি ওমর এবং হাসান উভয়কেই রাজ দরবারে ডেকে এনে উচ্চপদ প্রদান করলেন। ওমর নিজে একজন সফল পণ্ডিত ছিলেন, উচ্চ পদের জন্য তার বিশেষ কোন উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না। পরিবর্তে, তিনি নিজামের কাছে চাইলেন যে তিনি যেন চিরকাল নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেন। নিজাম ওমরের জন্য একটি মানমন্দির নির্মাণ করে দিলেন এবং তার জন্য দশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা পাঠালেন।
হাসান কিন্তু, ওমরের পথে না চলে, তাঁকে যে নিয়োগের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল তা গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই, তিনি পালিয়ে যেতে বাধ্য হলেন কারণ তিনি নিজামকে উজির পদ থেকে সরানোর জন্য ষড়যন্ত্র করে ধরা পড়ে গিয়েছিলেন।
![](http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/thumb/a/af/Assassination_of_Nizam_al-Mulk.jpg/220px-Assassination_of_Nizam_al-Mulk.jpg)
নিজাম হাসানকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিলেন। হাসান পারস্যের উত্তর দিকে চলে গিয়ে এমন একটি গ্রামে লুকিয়ে রইলেন যেখানকার বেশিরভাগ লোক গোপনভাবে ছিল ইসমাইলি। সেখানে তিনি স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে জোট বাঁধলেন। গ্রামের কাছেই আলামুত নামে একটি কিংবদন্তি দুর্গ ছিল, এটি কখনোই সামরিক উপায়ে রক্ষার ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। হাসান সহ গ্রামের অনেক লোক ধীরে ধীরে প্রহরী ও শ্রমিক হিসাবে দুর্গে প্রবেশ করলেন। সেখানে হাসান ধীরে ধীরে দুর্গের অনেক সৈন্যের বিশ্বাস ও বন্ধুত্ব অর্জন করলেন। শেষ পর্যন্ত একদিন আলমুত দুর্গস্বামীর কাছে, হাসান নিজের আসল পরিচয় প্রকাশ করলেন এবং দাবি করলেন যে দুর্গটি এখন তারই। দুর্গস্বামী হাসানকে গ্রেপ্তার করার জন্য রক্ষীদের নির্দেশ দিলেন, কিন্তু বিস্ময়ের সাথে দেখলেন তারা সবাই গোপনে হাসানের সমর্থক। হাসান তখন দুর্গটিকে তার নতুন ইসমাইলি আদেশের কেন্দ্রে পরিণত করলেন। তাঁদের কোন সেনাবাহিনী ছিলনা। তখন হাসান এবং তার অনুসারীরা শত্রু নেতাদের নির্মূল করার জন্য গোপনে হত্যাকাণ্ড শুরু করে দিলেন। যখন তারা হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্যে বেরোতেন, তারা গাঁজা সেবন করে নিতেন, এই মাদক তাঁদের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী করে তুলত।
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- Recounted by Jorge Luis Borges