তথ্যগুপ্তিবিদ্যা/তথ্যগুপ্তিবিদ্যার শুরু ও খনুমহোতেপ

উইকিবই থেকে

তথ্যগুপ্তিবিদ্যা এবং প্রাচীন সভ্যতা গুলো[সম্পাদনা]

ঐতিহাসিকভাবে লিপিবদ্ধ গুপ্তলিখনের প্রথম উদাহরণটি আমরা পাই প্রাচীন মিশরে, আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর পূর্বে। মিশরে তখন দ্বাদশ রাজবংশের সম্রাট দ্বিতীয় আমেনেমহেতের শাসনামল, তার অধীনে উচ্চ মিশরের মেনেত খুফু নগরীর প্রশাসক ছিলেন দ্বিতীয় খনুমহোতেপ। মৃত্যুর পূর্বে নিজের বংশলতিকা, সমরাভিযান ও অর্জনসমূহ চুনাপাথরের পাহাড়চূড়ায় উৎকীর্ণ করে যান খনুমহোতেপ। সমাধিলিপির বিশ্লেষণে রহস্যজনকভাবে পরিলক্ষিত হয়, বর্ণনার শেষাংশে এসে হায়ারোগ্লিফের চিহ্নগুলো বিভিন্ন জায়গায় পাল্টে দিয়েছে খনুমহোতেপের সুবর্ণিকগণ, সুপরিচিত চিহ্নের পরিবর্তে কম প্রচলিত চিহ্ন ব্যবহার করেছে, লঙ্ঘন করেছে ব্যাকরণবিধির।

সুবর্ণিকগণ কেন কাজটি করেছিলেন, আজ আর সঠিকভাবে জানা যায় না, তবে কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের মতে, খনুমহোতেপের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াসংক্রান্ত বিশেষ এ অনুচ্ছেদটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে পাল্টে দেয়া হয়েছে যাতে জনসাধারণের কাছে তা অস্পষ্ট থেকে যায়।

১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মেসোপটেমীয় একটি কীলকলিখন (cuneiform)-ফলকে তথ্যগুপ্তিকরণের (encryption) আরও উৎকর্ষতার প্রমাণ পাওয়া যায়। দজলা নদীর তীরে আবিষ্কৃত ৩ ইঞ্চি x ২ ইঞ্চি মাপের এ ফলকটিতে তৈজসপত্র উজ্জ্বলকরণের একটি সূত্র লুকিয়ে রাখা হয় গুপ্তসংকেতের মাধ্যমে। সূত্রটিতে এমন সব চিহ্ন ব্যবহার করা হয়েছিল বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে যার রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন অর্থ।

৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, হিব্রু লেখকগণ নবী ইয়াহইয়া'র বাইবেল গ্রন্থটির অনুলিপি তৈরিতে বর্ণপ্রতিস্থাপন ধরণের এক গুপ্তলিখনপ্রণালী (cipher) অবলম্বন করেন, যা আজকে আতবাশ (atbash) নামে পরিচিত।

তথ্যগুপ্তিকরণের গ্রিক উদাহরণ আমরা পাই হেলেকারন্যাসিসের হিরোডিটাস রচিত ইতিহাস গ্রন্থটিতে, যাতে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে সংঘটিত গ্রিস ও পারস্যের যুদ্ধবিবাদের ঘটনা বর্ণনা করেন তিনি। পারস্যরাজ জেরেক্স (Xerxes) গ্রিকদের উপর অতর্কিত আক্রমণের জন্য সৈন্যসামন্ত জড়ো করতে থাকেন গোপনে। ঘটনাক্রমে সেসময় পারস্যদেশেই নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছিল ডিমেরাটাস নামে এক গ্রিক। দেশের জনগণ ডিমেরাটাসকে বিতাড়িত করলেও মাতৃভূমির বিপদে উদাসীন থাকতে পারল না সে, কাঠের ফলকে বিপদের কথা বর্ণনা করে তার উপর মোমের প্রলেপ দিয়ে পাঠিয়ে দিল গ্রিসে। পারস্যদেশের চৌকিগুলোতে পাহারাদারগণ সবরকমের তল্লাশি চালিয়ে গেলেও নিরীহ কাঠের ফলকটি তাদের হাত দিয়েই বেরিয়ে চলে গেল গ্রিসে। অভিযানের শুরুতেই সম্রাট জেরেক্সই উল্টো অতর্কিত গ্রিক আক্রমণের মুখোমুখি হয়ে পরাস্ত হন।

হিরোডিটাস আরেকটি ঘটনার বর্ণনা করেন: মাইলেটাস নগরীর স্বৈরশাসক হিসটিয়াইয়ুস তার জামাতা ও উপদেষ্টা অ্যারিস্টাগোরাসকে একটি গোপন সংবাদ প্রেরণের ইচ্ছা পোষণ করেন। এ উদ্দেশ্যে হিসটিয়াইয়ুস তার এক চাকরের মস্তিষ্ক মুণ্ডন করে তাতে সংবাদটি লিখে রাখেন, এবং বেশ কিছুদিন পর চাকরের চুল গজালে তাকে পাঠিয়ে দেন অ্যারিস্টাগোরাসের কাছে। চাকরের চুল পুনরায় মুণ্ডন করে গুপ্তলিপিটি উদ্ধার করেন অ্যারিস্টাগোরাস, এবং তদনুযায়ী পারস্যরাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে দেন দ্রুত।

মূল তথ্যকে পরিবর্তন না করে কেবল শত্রুর নজর থেকে গোপন রাখার এ পদ্ধতিকে বলা হয় স্টেগানোগ্রাফি (steganography)।

কেল্টিক গোত্রসমূহের বিরুদ্ধে পরিচালিত গলের যুদ্ধে জুলিয়াস সিজারের সেনাপতি কুইন্টাস তুলিয়াস সিসেরো শত্রুবেষ্টিত হয়ে যখন আত্মসমর্পণের দিন গুনছিল, দ্রুত এক চিঠি দিয়ে সৈনিক পাঠান সিজার তার কাছে। চিঠিতে রোমান বর্ণগুলো গ্রিক বর্ণ দ্বারা প্রতিস্থাপন করে দেন তিনি, যাতে সৈনিক ধরা পড়লেও শত্রু তার পাঠোদ্ধার করতে না পারে। সিজারের চিঠি পেয়ে মনোবল চাঙা হয় সিসেরো বাহিনীর, এর কিছুদিন পরই সিজার উদ্ধার করে তাদের।

সিজার আরও এক ধরণের প্রতিস্থাপন সাইফার ব্যবহার করতেন বলে জানা যায়। যেখানে চিঠির প্রতি বর্ণকে বর্ণমালায় তার তিন ঘর ডানের বর্ণটি দিয়ে প্রতিস্থাপন করতেন। অর্থাৎ "প্রতিরোধ করো, আমি আসছি" এ সংবাদটি সিজার লিখতেন এভাবে "ভষধঊষখফ ঘষখ উলঊ উড়ঞঊ"

চতুর্থ শতকে ব্রাহ্মণ পণ্ডিত বাৎসায়ন কামসূত্র নামে বড়দের জন্য যে বইটি রচনা করেন, তাতে মেয়েদের জন্য চৌষট্টি কলা শিক্ষার প্রস্তাব করেন তিনি। রন্ধন, পোশাক পরিধান এবং প্রসাধন প্রস্তুতকরণের মতো সুপরিচিত কলার পাশাপাশি ম্লেচ্ছিত বিকল্প বা গুপ্তলিখন বিদ্যা নামে গূঢ় এক কলা উল্লেখ করেন তিনি, তালিকার ৪৫ নম্বরে, যার দ্বারা নারীরা তাদের গোপন প্রণয়ের কাহিনী নিশ্চিত গোপনীয়তায় সংরক্ষণ করতে পারবে। তার একটি পদ্ধতি হচ্ছে, বর্ণমালার প্রতিটি বর্ণকে দৈবক্রমে অন্য একটি বর্ণের সাথে প্রতিবর্ণ হিসেবে সমন্বিত করা, এবং কাহিনী রচনার সময় মূল বর্ণকে তার প্রতিবর্ণ দিয়ে প্রতিস্থাপিত করে ফেলা।

তাওরাত ও ইঞ্জিলে গূঢ়ার্থ আবিষ্কারের উদ্দেশ্যে ইউরোপের মঠগুলোতে ব্যাপকভাবে গুপ্তলিখনের চর্চা হয় অন্ধকার যুগে। সন্যাসী রজার বেকন, যিনি আরব গ্রন্থসমূহ দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন, গুপ্তলিপির উপর রচনা করেন "Epistle on the Secret Works of Art and the Nullity of Magic"। ক্যান্টারবুরি কাহিনী-খ্যাত জিওফ্রে চসার জ্যোতির্বিদ্যার উপর তাঁর একটি গ্রন্থের কয়েকটি অনুচ্ছেদ গুপ্তলিখনের মাধ্যমে প্রকাশ করেন।

রেনেঁসার যুগে বিজ্ঞানের নানা শাখায় নিজেদের ধারণা চুরি হয়ে যাওয়ার ভয়ে থাকতেন আবিষ্কারকগণ, ফলে নিজস্ব গবেষণার প্রাথমিক ফলাফল অনেক সময় তাঁরা প্রকাশ করতেন সংকেতের মাধ্যমে। উদাহরণস্বরূপ, ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানী হুক তাঁর একটি আবিষ্কারকে বর্ণনা করেন এভাবে: ceiiinosssttuv; সংকেতের সমাধানটি তিনি প্রকাশ করেন দেড়যুগ পরে, পূর্বের বর্ণগুলো পুনর্বিন্যস্ত করে: ut tensio, sic vis—সেরকমই প্রসারণ, যেরকম প্রযুক্ত বল, আজকে যা হুকের স্থিতিস্থাপকতা সূত্র নামে পরিচিত।

এছাড়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মেক্সিকোর কাছে পাঠানো জার্মানির জিমারম্যান টেলিগ্রাম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির ব্যবহৃত এনিগমা মেশিনের পাঠোদ্ধার বিশ্বযুদ্ধকে সংক্ষিপ্ত করে ইতিহাসের গতিপথকেই পাল্টে দিয়েছে।

ইতিহাসের পাতায় ছড়িয়ে আছে তথ্যগুপ্তিকরণের করুণ উদাহরণও। স্কটল্যান্ডের রাণী মেরি তার প্রটেস্ট্যান্ট চাচাতো বোন প্রথম এলিজাবেথকে ইংল্যান্ডের সিংহাসন থেকে উৎখাতের পরিকল্পনায় ক্যাথলিক যড়যন্ত্রকারীদের সাথে যোগ দেন; গুপ্তলিখনের মাধ্যমে সংবাদ আদানপ্রদান করতে থাকেন তারা। একসময় রাণীর গুপ্তচরদের হস্তগত হয় কিছু সংবাদ এবং প্রচুর পরিশ্রমের পর সেগুলোর মর্মোদ্ধার (decipher) করেন তারা। এলিজাবেথ ও মেরি, একই বিছানায় হেসেখেলে যারা কাটিয়েছিলেন শৈশবের অনেকটা সময়, জীবনকে শেষ পর্যন্ত আবিষ্কার করেছিলেন একেবারেই ভিন্নভাবে। ১৫৮৭ খ্রিস্টাব্দে এলিজাবেথের নির্দেশে শিরশ্ছেদ করা হয় মেরির।