বিষয়বস্তুতে চলুন

মানব শারীরতত্ত্ব/জিনতত্ত্ব ও বংশগতি

উইকিবই থেকে
← গর্ভধারণ ও সন্তান প্রসব — মানব শারীরতত্ত্ব — জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি বেড়ে উঠা →

হোমিওস্ট্যাসিসকোষ শারীরতত্ত্বত্বকতন্ত্রস্নায়ুতন্ত্রইন্দ্রিয়পেশীতন্ত্ররক্ত শারীরবিদ্যাসংবহনতন্ত্রঅনাক্রম্যতন্ত্রমূত্রতন্ত্রশ্বসনতন্ত্রপরিপাকতন্ত্রপুষ্টিঅন্তঃক্ষরা গ্রন্থিতন্ত্রপ্রজনন (পুরুষ)প্রজনন (নারী)গর্ভধারণ ও সন্তান প্রসবজিনতত্ত্ব ও বংশগতিজন্ম থেকে মৃত্যু অবধি বেড়ে উঠাউত্তরমালা

ভূমিকা

[সম্পাদনা]

জেনেটিক্স বা বংশগতিবিজ্ঞান হলো এমন একটি বিজ্ঞান যা বোঝায় কিভাবে বৈশিষ্ট্যগুলো পিতামাতা থেকে সন্তানদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। জীবনের প্রতিটি রূপের জন্য প্রজাতির ধারাবাহিকতা নির্ভর করে এই জেনেটিক কোডের ওপর, যা বাবা-মায়ের থেকে সন্তানের মধ্যে স্থানান্তরিত হয়। প্রকৃতির নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তন সম্ভব তখনই, যখন বৈশিষ্ট্যগুলো উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত হয়।

মানব শারীরবিজ্ঞানে জেনেটিক্স খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ মানুষের শরীরের প্রতিটি গুণাবলি তার জেনেটিক কোড দ্বারা প্রভাবিত হয়। এটা চোখের রঙ, উচ্চতা বা চুলের রঙের মতো সাধারণ কিছু হতে পারে। আবার যকৃৎ কীভাবে বিষাক্ত পদার্থ প্রক্রিয়াজাত করে, হৃদরোগ বা স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি আছে কিনা, কিংবা আপনি রঙ অন্ধ কিনা—এসবও নির্ভর করে আপনার জেনেটিক কোডের ওপর।

জেনেটিক কোডে ত্রুটি অনেক সময় মারাত্মক হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ: ডাউন সিনড্রোম, টার্নার সিনড্রোম এবং ক্লাইনফেলটার সিনড্রোম এসব রোগ ক্রোমোজোমের ত্রুটির কারণে হয়। সিস্টিক ফাইব্রোসিস হয় জেনেটিক সিকোয়েন্সে একটি মাত্র পরিবর্তনের কারণে।

জেনেটিক উত্তরাধিকার শুরু হয় গর্ভধারণের সময় থেকে। আপনি আপনার মায়ের কাছ থেকে ২৩টি এবং বাবার কাছ থেকে ২৩টি করে ক্রোমোজোম পেয়েছেন। মিলিয়ে মোট ২২ জোড়া অটোসোমাল ক্রোমোজোম এবং ১ জোড়া যৌন ক্রোমোজোম (যদি আপনি নারী হন তবে XX, পুরুষ হলে XY)। হোমোলগাস ক্রোমোজোমে একই জিন একই অবস্থানে থাকে, কিন্তু এই জিনের বিভিন্ন অ্যালিল (রূপ) থাকতে পারে।

একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে কোনো একটি জিনের অনেক অ্যালিল থাকতে পারে, কিন্তু একজন ব্যক্তির থাকে কেবল দুটি কপি—যা একই রকম হলে তাকে বলা হয় হোমোজাইগাস, আর ভিন্ন হলে হেটারোজাইগাস।

জেনেটিক্স চিকিৎসাবিজ্ঞানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যখন জানা যায় যে কোন জেনেটিক ত্রুটি কীভাবে রোগ সৃষ্টি করে, তখন সেই রোগের চিকিৎসা বা প্রতিকার খুঁজে পাওয়া সহজ হয়। ২০০৩ সালে মানব জেনোমের সম্পূর্ণ সিকোয়েন্স (প্রায় ৩ বিলিয়ন বেস পেয়ার এবং আনুমানিক ২০,০০০–২৫,০০০ প্রোটিন-কোডিং জিন) সম্পন্ন হয়। তবে এখনও সব জিনের কাজ ও নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে আমাদের পূর্ণ ধারণা নেই।

চিকিৎসাবিজ্ঞান এখন ধীরে ধীরে উপসর্গের ভিত্তিতে রোগ নির্ণয় থেকে জেনেটিক ভিত্তিতে রোগ নির্ণয়ের দিকে এগোচ্ছে, এবং আমরা প্রবেশ করছি এমন এক যুগে, যাকে অনেকে বলছেন ‘ব্যক্তিগতকৃত চিকিৎসার যুগ’।

ডিএনএ

[সম্পাদনা]

ডিএনএ বা ডিঅক্সিরাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড হলো এমন একটি বৃহৎ অণু যা কোষের কাঠামোগত ও কার্যকরী উপাদান তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংরক্ষণ করে। এটি যখন পিতামাতা থেকে সন্তানের মধ্যে যায়, তখন উত্তরাধিকার সংক্রান্ত ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। এই ধারণাগুলোর সম্মিলনে আমরা একটি কার্যকরী সংজ্ঞা পাই—একটি জিন হলো ডিএনএ-র একটি অংশ যা কোনো নির্দিষ্ট প্রোটিন তৈরির নির্দেশনা দেয় এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়।

কোনো জীবের বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য (ফেনোটাইপ) অনেকাংশে নির্ভর করে তার জিনের (জেনোটাইপ) ওপর। তাই ডিএনএ স্তরে পার্থক্য থাকলে, তা পুরো জীবের স্তরে বৈচিত্র্য তৈরি করতে পারে। এই ধারণাগুলোই হলো জেনেটিক্সবিবর্তন তত্ত্বের ভিত্তি।

ডিএনএ অণুর ঘূর্ণায়মান অ্যানিমেশন

একটি জিন হলো ডিএনএ-র ছোট একটি অংশ, যা কোষের নিউক্লিয়াসের ভেতর ক্রোমোজোমে থাকে। জিন সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও দেহের কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। একটি নির্দিষ্ট জিন কোষের কার্যক্রমে প্রভাব ফেলে; এবং বহু কোষে একই জিন একসঙ্গে কাজ করে শরীরের কোনো নির্দিষ্ট শারীরিক বা রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে (যেমন চোখের রঙ বা প্রজনন কার্যক্রম)।

প্রতিটি মানব কোষে আনুমানিক ৩০,০০০ জিন থাকে। যদিও সব কোষে এক ধরনের জিন থাকে, তবুও ভিন্ন ভিন্ন কোষে ভিন্ন ভিন্ন জিন সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় থাকে। এই কারণেই যকৃত কোষ ও মস্তিষ্ক কোষের মধ্যে পার্থক্য হয়।

জেনোটাইপ হলো কোনো নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের জন্য ব্যক্তির জিনের প্রকৃত জোড়া। যেমন, কোনো নারী হিমোফিলিয়ার বাহক হতে পারেন, যদি তার এক কপি স্বাভাবিক ও এক কপি ত্রুটিপূর্ণ ক্লটিং প্রোটিন জিন থাকে। তার ফেনোটাইপ হবে স্বাভাবিক, কারণ স্বাভাবিক জিনটি ত্রুটিপূর্ণটির উপর আধিপত্য বিস্তার করে।

ফেনোটাইপ হতে পারে যেকোনো পরিমাপযোগ্য বৈশিষ্ট্যের—চোখের রঙ, আঙুলের দৈর্ঘ্য, উচ্চতা, ক্যালসিয়াম পাম্প করার ক্ষমতা, হাসির ধরণ, রক্তের গ্রুপ বা কোলেস্টেরলের মাত্রা ইত্যাদি।

জেনোটাইপ সবসময় ফেনোটাইপ দেখে অনুমান করা যায় না। যেমন ঐ নারী বাহক কিনা, তা শুধু বাহ্যিকভাবে দেখে বোঝা যাবে না। তবে বংশবৃত্তান্ত বিশ্লেষণ বা জেনেটিক পরীক্ষা দিয়ে তা নির্ণয় করা যায়।

যদিও জেনোটাইপ ফেনোটাইপের পূর্বাভাস দিতে পারে, তবুও পরিবেশগত প্রভাবও একটি বড় ভূমিকা পালন করে। যেমন, অভিন্ন যমজ ভাইবোনদের জেনেটিক কোড এক হলেও তারা ব্যক্তিত্ব, দেহের ওজন, এমনকি আঙুলের ছাপেও ভিন্ন হতে পারে।

জেনেটিক্স

[সম্পাদনা]

জেনেটিক্স (গ্রিক শব্দ genno যার অর্থ জন্ম দেয়া) হলো জিন, উত্তরাধিকার ও জীবদের বৈচিত্র্যের বিজ্ঞান। ব্রিটিশ বিজ্ঞানী উইলিয়াম বেটসন ১৯০৫ সালের ১৮ এপ্রিল অ্যাডাম সেজউইকের কাছে পাঠানো ব্যক্তিগত চিঠিতে প্রথমবারের মতো “জেনেটিক্স” শব্দটি ব্যবহার করেন উত্তরাধিকার এবং বৈচিত্র্য অধ্যয়নের ক্ষেত্রে। ১৯০৬ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত তৃতীয় আন্তর্জাতিক জেনেটিক্স সম্মেলনে তিনি সর্বপ্রথম প্রকাশ্যে এই শব্দটি ব্যবহার করেন।

উত্তরাধিকার ও বৈচিত্র্য—এই দুটি বিষয়ই জেনেটিক্সের ভিত্তি। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ উদ্ভিদ ও প্রাণীর গৃহপালন ও প্রজননের মাধ্যমে জেনেটিক্সের ব্যবহার করে আসছে। আধুনিক গবেষণায় জেনেটিক্স গুরুত্বপূর্ণ টুল সরবরাহ করে, যেমন জিনের কার্যকারিতা বোঝার জন্য জেনেটিক ইন্টারঅ্যাকশন বিশ্লেষণ।

জীবের মধ্যে জেনেটিক তথ্য সাধারণত ক্রোমোজোমে সংরক্ষিত থাকে, যা নির্দিষ্ট ডিএনএ অণুর রাসায়নিক কাঠামো দ্বারা প্রকাশিত হয়।

মেনডেল পর্যবেক্ষণ করেছিলেন এমন সাতটি বৈশিষ্ট্য প্রদর্শনকারী চিত্র

জিন প্রোটিন তৈরির জন্য অ্যামিনো অ্যাসিডের সিকোয়েন্স নির্ধারণ করে, যা আবার জীবের বাহ্যিক গঠন নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ডিপ্লয়েড জীবগুলোর ক্ষেত্রে, একটি ক্রোমোজোমে থাকা প্রভাবশালী (ডমিনেন্ট) অ্যালিল অন্যটির দুর্বল (রিসেসিভ) অ্যালিলকে ঢেকে দেয়।

সব জিন একভাবে কাজ করে না। কেউ কেউ সহ-প্রভাবশালী (কোডমিনেন্ট), কেউ আবার ভিন্ন ভিন্নভাবে প্রকাশ পায়। ‘‘কোড ফর’’ কথাটি ব্যবহৃত হয় এই অর্থে যে, একটি জিন নির্দিষ্ট প্রোটিন তৈরির নির্দেশ বহন করে। আগে ভাবা হতো, এক জিন এক প্রোটিন। এখন জানা গেছে, একটি জিন থেকে একাধিক প্রোডাক্ট তৈরি হতে পারে, নির্ভর করে কিভাবে তার ট্রান্সক্রিপশন নিয়ন্ত্রিত হয়।

জিন এমআরএনএ ও আরআরএনএর নিউক্লিওটাইড সিকোয়েন্স নির্ধারণ করে, যা প্রোটিন সংশ্লেষে প্রয়োজন।

গ্রেগর মেন্ডেল উদ্ভিদে উত্তরাধিকার নীতির উপর গবেষণা করেন। তিনি বুঝতে পারেন, এই নীতিগুলো মানুষ ও প্রাণীর ক্ষেত্রেও একইভাবে প্রযোজ্য।

তিনি মটরশুঁটির গাছে পরীক্ষা করেন। কয়েক প্রজন্ম ধরে লক্ষ্য করেন যে, কিছু বৈশিষ্ট্য এমনভাবে উত্তরসূরিতে প্রকাশ পায় যেখানে পিতামাতার বৈশিষ্ট্য মিশে যায় না। এটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তখন ধারণা ছিল বৈশিষ্ট্যগুলো এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে মিশে যায়।

মেনডেলীয় বংশগতির ১:২:১ অনুপাত

মটরশুঁটির গাছ সহজেই প্রজনন নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। এতে পুরুষ ও নারী অংশ দুটোই থাকে এবং সহজেই বড় পরিসরে চাষ করা যায়। ফলে এগুলো আত্মপরাগায়ন বা পরস্পরের সঙ্গে পরাগায়ন করতে পারে।

যেমন, দুটি বিশুদ্ধ প্রজাতির মধ্যে একটি হলুদ ও অন্যটি সবুজ বীজযুক্ত গাছ পরাগায়িত করলে প্রথম প্রজন্ম সবগুলো হলুদ বীজযুক্ত হয়। পরবর্তী প্রজন্মে ৩:১ অনুপাতে হলুদ ও সবুজ বীজ দেখা যায়। প্রতিটি ক্ষেত্রে দেখা যায়, একটি বৈশিষ্ট্য অন্যটির ওপর আধিপত্য বিস্তার করে এবং অন্যটি লুকায়িত থাকে। তবে জিনটি থেকে যায় এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মে তা প্রকাশ পেতে পারে।

গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের সময়রেখা

১৮৫৯ চার্লস ডারউইন প্রকাশ করেন দ্য অরিজিন অফ স্পিসিস ১৮৬৫ গ্রেগর মেনডেল-এর প্রবন্ধ, উদ্ভিদের সংকরায়নের উপর পরীক্ষা

১৯০৩ ক্রোমোজোমকে বংশগতির একক হিসেবে আবিষ্কার করা হয়

১৯০৬ "জেনেটিক্স" শব্দটি প্রথমবারের মতো জনসমক্ষে ব্যবহার করেন ব্রিটিশ জীববিজ্ঞানী উইলিয়াম বেটসন লন্ডনে অনুষ্ঠিত তৃতীয় আন্তর্জাতিক জেনেটিক্স সম্মেলনে

১৯১০ থমাস হান্ট মরগান দেখান যে জিনগুলো ক্রোমোজোমে অবস্থান করে, এবং তিনি এমন কিছু সংযুক্ত জিন আবিষ্কার করেন যেগুলো মেনডেলের স্বাধীন বংশগতির সূত্র মানে না

১৯১৩ আলফ্রেড স্টার্টেভ্যান্ট প্রথম একটি ক্রোমোজোমের জেনেটিক মানচিত্র তৈরি করেন

১৯১৩ জিন মানচিত্রে দেখা যায় যে ক্রোমোজোমে জিনগুলো সরলরেখায় বিন্যস্ত থাকে

১৯১৮ রোনাল্ড ফিশার মেন্ডেলীয় উত্তরাধিকারের ধারণার উপর ভিত্তি করে আত্মীয়দের মধ্যকার সম্পর্কের পারস্পরিক সম্পর্ক প্রকাশ করেন – আধুনিক সংশ্লেষণ শুরু হয়

১৯২৭ জিনে শারীরিক পরিবর্তনকে বলা হয় মিউটেশন

১৯২৮ ফ্রেডরিক গ্রিফিথ এমন একটি বংশগত অণু আবিষ্কার করেন যা ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে স্থানান্তরযোগ্য

১৯৩১ রিকম্বিনেশনের কারণ হিসেবে "ক্রসিং ওভার" চিহ্নিত হয়

১৯৪১ এডওয়ার্ড লরি ট্যাটাম এবং জর্জ বীডল দেখান যে জিন প্রোটিনের জন্য কোড করে

১৯৪৪ অসওয়াল্ড থিওডর অ্যাভেরি, কলিন ম্যাকলিয়ড এবং ম্যাকলিন ম্যাককার্টি ডিএনএ-কে বংশগত উপাদান হিসেবে নির্ধারণ করেন (তখন একে বলা হতো "ট্রান্সফর্মিং প্রিন্সিপল")

১৯৫০ এরউইন চার্গাফ দেখান যে নিউক্লিক অ্যাসিডে চারটি নিউক্লিওটাইড সমান অনুপাতে থাকে না, তবে কিছু সাধারণ নিয়ম বিদ্যমান (যেমন: অ্যাডেনিন-থাইমিন এবং সাইটোসিন-গুয়ানিন সবসময় সমান অনুপাতে থাকে)

১৯৫০ বারবারা ম্যাকক্লিনটক ভুট্টায় ট্রান্সপোজন আবিষ্কার করেন

১৯৫২ হার্শি-চেজ পরীক্ষা প্রমাণ করে যে ফেজসহ সব জীবের বংশগত তথ্য ডিএনএ-তে থাকে

১৯৫৩ জেমস ডি. ওয়াটসন এবং ফ্রান্সিস ক্রিক রোজালিন্ড ফ্র্যাঙ্কলিন-এর সহায়তায় ডিএনএ-এর গঠনকে দ্বৈত সর্পিল হিসেবে চিহ্নিত করেন

১৯৫৬ জো হিন টজিও এবং আলবার্ট লেভান মানুষের ক্রোমোজোম সংখ্যা সঠিকভাবে ৪৬ নির্ধারণ করেন

১৯৫৮ মেসেলসন-স্টল পরীক্ষা প্রমাণ করে যে ডিএনএ আধা-সংরক্ষণশীলভাবে প্রতিলিপি হয়

১৯৬১ জেনেটিক কোড তিনটি বেস নিয়ে গঠিত (ট্রিপলেট)

১৯৬৪ হাওয়ার্ড টেমিন আরএনএ ভাইরাস ব্যবহার করে দেখান যে ওয়াটসনের কেন্দ্রীয় মতবাদ সবসময় প্রযোজ্য নয়

১৯৭০ ব্যাকটেরিয়া হেমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা-এর উপর গবেষণায় রেস্ট্রিকশন এনজাইম আবিষ্কৃত হয়, যা ডিএনএ কেটে সংযুক্ত করতে বিজ্ঞানীদের সক্ষম করে

১৯৭৭ ফ্রেড স্যাঙ্গার, ওয়াল্টার গিলবার্ট এবং অ্যালান ম্যাক্সাম স্বাধীনভাবে প্রথমবারের মতো ডিএনএ সিকোয়েন্স করেন। স্যাঙ্গারের ল্যাব ব্যাকটেরিওফেজের সম্পূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্স সম্পন্ন করে

১৯৮৩ কেরি ব্যাংকস মুলিস পলিমারেজ চেইন রিয়্যাকশন আবিষ্কার করেন, যা ডিএনএ সহজে বহুগুণে প্রতিলিপি করা সম্ভব করে

১৯৮৫ অ্যালেক জেফরিস জেনেটিক ফিঙ্গারপ্রিন্টিং আবিষ্কার করেন

১৯৮৯ ফ্রান্সিস কলিন এবং ল্যাপ-চি ছুই প্রথম মানব জিন সিকোয়েন্স করেন। এটি CFTR প্রোটিন কোড করে। এই জিনে ত্রুটি সিস্টিক ফাইব্রোসিস রোগের কারণ

১৯৯৫ হেমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা-র জিনোম প্রথম স্বাধীন জীব হিসেবে সম্পূর্ণ সিকোয়েন্স করা হয়

১৯৯৬ স্যাকারোমাইসেস সারেভিসিয়ে-র জিনোম প্রথম ইউক্যারিওটিক জিনোম হিসেবে প্রকাশিত হয়

১৯৯৮ সি. এলিগ্যান্স-এর জিনোম প্রথম বহুকোষী ইউক্যারিওটিক জীব হিসেবে সিকোয়েন্স করা হয়

২০০১ হিউম্যান জিনোম প্রকল্প এবং সেলেরার জিনোমিক একইসাথে মানব জিনোমের প্রথম খসড়া প্রকাশ করে

২০০৩ (১৪ এপ্রিল) হিউম্যান জিনোম প্রকল্প সফলভাবে সম্পন্ন হয়, যেখানে ৯৯% জিনোম ৯৯.৯৯% নির্ভুলতায় সিকোয়েন্স করা হয়

২০০৬ মার্কাস পেমব্রে এবং ওলভ বাইগ্রেন লিঙ্গ-নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য, মানবদেহে পুরুষ সুত্রধর প্রজন্মান্তর প্রতিক্রিয়া শিরোনামে প্রবন্ধ প্রকাশ করেন, যা এপিজেনেটিক্সের প্রমাণ প্রদান করে

ট্রান্সক্রিপশন ও ট্রান্সলেশন

[সম্পাদনা]

ট্রান্সক্রিপশন হলো আরএনএ তৈরির প্রক্রিয়া। একটি এনজাইম RNA পলিমারেজ, জিনের হাইড্রোজেন বন্ড ভেঙে দেয়। জিন হলো ডিএনএ-র একটি অংশ, যা প্রোটিন তৈরির তথ্য বহন করে। হাইড্রোজেন বন্ড ভাঙার পর এটি জিন বরাবর নিচের দিকে এগোয়। এরপর RNA পলিমারেজ নিউক্লিওটাইডগুলো এমনভাবে সাজায় যেন তা পরিপূরক হয়। কিছু RNA নিউক্লিয়াস থেকে বেরিয়ে নির্দিষ্ট কাজ করে।

ট্রান্সলেশন হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে mRNA এর নির্দেশনা অনুসারে রাইবোজোমে প্রোটিন তৈরি হয়।

  1. mRNA-র বেস সিকোয়েন্স অ্যামিনো অ্যাসিডের সঠিক ক্রম নির্ধারণ করে।
  2. ট্রান্সক্রিপশন নিউক্লিয়াসে হয়। তারপর mRNA নিউক্লিয়াস থেকে বেরিয়ে সাইটোপ্লাজমে যায় এবং একটি রাইবোজোমের সঙ্গে যুক্ত হয়।
  3. মেথিওনিন-tRNA AUG (স্টার্ট কডন) এর সঙ্গে যুক্ত হয়।
  4. এরপর এটি বড় রাইবোজোমাল সাবইউনিটের সঙ্গে যুক্ত হয়। মেথিওনিন-tRNA P-সাইটে থাকে।
  5. দ্বিতীয় tRNA, যার সঙ্গে আরেকটি অ্যামিনো অ্যাসিড (লাইসিন) যুক্ত, A-সাইটে দ্বিতীয় কডনের সঙ্গে যুক্ত হয়।
  6. পেপটাইডাইল ট্রান্সফারেজ নামক এনজাইম মেথিওনিন ও লাইসিনের মধ্যে একটি পেপটাইড বন্ড তৈরি করে।
  7. প্রথম tRNA ছেড়ে দেয় এবং mRNA একটি কডন সামনে সরে যায়।
  8. এরপর আরেকটি tRNA (যার সঙ্গে গ্লুটামিন যুক্ত) A-সাইটে আসে এবং কডনের সঙ্গে যুক্ত হয়।
  9. এখন এটি লাইসিন ও গ্লুটামিনের সঙ্গে একটি নতুন পেপটাইড বন্ড তৈরি করে।
  10. P-সাইটের tRNA ছেড়ে দেয় এবং তিনটি অ্যামিনো অ্যাসিডসহ নতুন tRNA P-সাইটে আসে।
  11. এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে যতক্ষণ না mRNA-তে স্টপ কডন (UAG) আসে, যা প্রোটিন তৈরির কাজ বন্ধ করে দেয়।

এই বিষয়গুলো সম্পর্কে আরও জানার জন্য কিছু ভালো ওয়েবসাইট:

A http://www.studiodaily.com/main/technique/tprojects/6850.html
B http://multimedia.mcb.harvard.edu/media.html

ভিডিও দেখতে চাইলে A সাইটে যান, আর বর্ণনা শুনতে চাইলে B সাইটে যান।

উত্তরাধিকার

[সম্পাদনা]

শিশুরা তাদের বাবা-মার কাছ থেকে বৈশিষ্ট্য, রোগ এবং স্বভাব উত্তরাধিকারসূত্রে পায়। বিশেষ করে শারীরিক গঠনে শিশুরা বাবা-মার সাথে মিল রাখে। তবে আচরণ, ব্যক্তিত্ব, এমনকি মানসিক সক্ষমতা বা অক্ষমতার দিকেও তারা বাবা-মার মতো হতে পারে। অনেক ভালো এবং খারাপ বিষয়ই পরিবারে প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলতে থাকে।

মানুষ প্রায়ই বলে, "এটা আমাদের পরিবারের স্বভাব", কিন্তু অনেক সময় এর পেছনে অন্য কারণও থাকতে পারে। যেমন, একটি পুরো পরিবার যদি অতিরিক্ত ওজনের হয়, তবে বলা হয় “এটা পারিবারিক”, কিন্তু সম্ভবত তারা সবাই অনেক হ্যামবার্গার খায় আর অতিরিক্ত মেওনেজ ব্যবহার করে। অথবা খাবারের পর সবাই সোফায় বসে থাকে আর সারা সন্ধ্যা নড়াচড়া করে না।

শিশুরা বাবা-মায়ের মতো কিছু অভ্যাস পেয়ে যেতে পারে—ভালো হোক বা খারাপ। যেমন, নখ কামড়ানো বা বই পড়ার আনন্দ। এসব জিনগতভাবে আসে না, বরং তারা বাবা-মাকে অনুকরণ করে, কারণ তারা মা-বাবার মতো হতে চায়। তাই ভালো উদাহরণ দেওয়া ভালো জিনগত গুণের মতোই গুরুত্বপূর্ণ।

উত্তরাধিকার প্যাটার্ন বর্ণনা উদাহরণ
অটোসোমাল ডমিনেন্ট একটি মাত্র বিকৃত জিন থাকলেই এই রোগ হতে পারে। সাধারণত, আক্রান্ত ব্যক্তির এক জন অভিভাবকও আক্রান্ত থাকেন। এই রোগ সন্তানের মধ্যে যাওয়ার সম্ভাবনা ৫০%। অনেক ডমিনেন্ট রোগ কম প্রবণতাসম্পন্ন, অর্থাৎ, এক কপি বিকৃত জিন থাকলেও অনেকেই জীবনের পরে অংশে গিয়ে রোগে আক্রান্ত হয়। হান্টিংটনস ডিজিজ, নিউরোফাইব্রোমাটোসিস ১, এইচওবিসি সিন্ড্রোম, বংশগত ননপলিপোসিস কোলোরেক্টাল ক্যান্সার
অটোসোমাল রিসেসিভ এই রোগ হতে হলে দুটি জিনই বিকৃত হতে হয়। আক্রান্ত ব্যক্তির বাবা-মা সাধারণত সুস্থ থাকেন কিন্তু একজন করে বিকৃত জিন বহন করেন (যাদের বলা হয় "ক্যারিয়ার")। দুজন সুস্থ ক্যারিয়ারের সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা প্রতি গর্ভাবস্থায় ২৫%। সিস্টিক ফাইব্রোসিস, সিকল সেল অ্যানিমিয়া, তে-সাক্স ডিজিজ, স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাট্রোফি, মাসকুলার ডিসট্রফি
এক্স-লিঙ্কড ডমিনেন্ট এই রোগ এক্স ক্রোমোজোমে জিনের মিউটেশনের ফলে হয়। মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়। একজন পুরুষ আক্রান্ত হলে তার কোনো ছেলেসন্তান আক্রান্ত হবে না, কিন্তু সব মেয়েসন্তান এই রোগ পাবে। একজন আক্রান্ত নারী প্রতিটি সন্তান নেওয়ার সময় ৫০% সম্ভাবনায় আক্রান্ত ছেলে বা মেয়ে পেতে পারেন। কিছু রোগ যেমন আইকার্ডি সিন্ড্রোম শুধুই মেয়েদের হয়, কারণ ছেলেরা এই রোগ নিয়ে বাঁচে না (যদি না তাদের ক্লাইনফেল্টার সিন্ড্রোম থাকে)। হাইপোফসফেটেমিয়া, আইকার্ডি সিন্ড্রোম
এক্স-লিঙ্কড রিসেসিভ এগুলোও এক্স ক্রোমোজোমে মিউটেশন থেকে হয়। ছেলেরা বেশি আক্রান্ত হয়। একজন পুরুষ আক্রান্ত হলে তার মেয়েরা ক্যারিয়ার হবে কিন্তু ছেলেরা হবে না। একজন ক্যারিয়ার নারী গর্ভে প্রতি সন্তান নেওয়ার সময় ৫০% সম্ভাবনায় আক্রান্ত ছেলে বা ক্যারিয়ার মেয়ে পেতে পারেন। হিমোফিলিয়া এ, ডুচেন মাসকুলার ডিসট্রফি, বর্ণান্ধতা, টার্নার সিন্ড্রোম
ওয়াই-লিঙ্কড ওয়াই ক্রোমোজোমে মিউটেশন থেকে এই রোগ হয়। কেবল ছেলেরাই আক্রান্ত হয় এবং একজন আক্রান্ত বাবার সব ছেলেসন্তান এই রোগ পায়। যেহেতু ওয়াই ক্রোমোজোম ছোট, এসব রোগ সাধারণত বন্ধ্যাত্ব সৃষ্টি করে, যা কিছু চিকিৎসার মাধ্যমে কাটিয়ে ওঠা যায়। পুরুষদের বন্ধ্যাত্ব
মাইটোকন্ড্রিয়াল এটি “মাতৃসূত্রে উত্তরাধিকার” নামে পরিচিত। কারণ কেবল ডিম্বাণু মাইটোকন্ড্রিয়া সরবরাহ করে, তাই কেবল মা-ই সন্তানকে এই রোগ দিতে পারেন। লেবারস হেরিডিটারি অপটিক নিউরোপ্যাথি

উত্তরাধিকারের প্রক্রিয়া

[সম্পাদনা]

একজন ব্যক্তির কোষে সেই সমস্ত জিন থাকে যা তার মা ও বাবার শুক্রাণু ও ডিম্বাণু থেকে এসেছে। এই জিনগুলো দীর্ঘ ডিএনএ রূপে থাকে। বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণকারী অধিকাংশ জিন একজোড়া করে থাকে—একটি মায়ের কাছ থেকে, আরেকটি বাবার কাছ থেকে। প্রত্যেক মানুষের শরীরে থাকে ২২ জোড়া অটোসোম এবং দুটি যৌন ক্রোমোজোম। মেয়েদের XX এবং ছেলেদের XY ক্রোমোজোম থাকে। জিনগত বৈশিষ্ট্য তিন ভাগে ভাগ করা যায়: একক জিনের উত্তরাধিকার, যৌন-লিঙ্কড উত্তরাধিকার, এবং বহু-গুণফলক (মাল্টিফ্যাক্টোরিয়াল) উত্তরাধিকার।

একক জিনের উত্তরাধিকার

[সম্পাদনা]
দুইজন ক্যারিয়ার পিতামাতার সন্তানের রিসেসিভ রোগ হওয়ার সম্ভাবনা দেখানো চিত্র

রক্তের গ্রুপ, চোখের রঙ, চুলের রঙ এবং স্বাদের বোধ—এসব একক জোড়া জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বলে ধারণা করা হয়। অস্ট্রিয়ান সন্ন্যাসী গ্রেগর মেন্ডেল প্রথম এটি আবিষ্কার করেন, যা এখন মেন্ডেলীয় উত্তরাধিকার সূত্র নামে পরিচিত।

একটি বৈশিষ্ট্য নির্ধারণকারী জিনের একাধিক রূপ থাকতে পারে যাকে অ্যালিল বলে। যেমন চুলের রঙের জন্য দুটি প্রধান অ্যালিল থাকে: লাল এবং বাদামি।

এ থেকে চারটি সম্ভাবনা হতে পারে:

বাদামি/লাল – ফলাফল: বাদামি চুল
লাল/লাল – ফলাফল: লাল চুল
বাদামি/বাদামি – ফলাফল: বাদামি চুল
লাল/বাদামি – ফলাফল: লাল চুল

অ্যালিলগুলো ডমিনেন্ট বা রিসেসিভ হতে পারে। ডমিনেন্ট অ্যালিল থাকলে সেটাই প্রকাশ পায়।

যখন দুই ব্যক্তি সন্তানের জন্ম দেন, তখন প্রত্যেকে একটি করে অ্যালিল দেন। যেমন, একজন বাবার যদি বাদামি/লাল জিন থাকে, তবে সন্তানের মধ্যে তিনি ৫০% সম্ভাবনায় বাদামি এবং ৫০% সম্ভাবনায় লাল জিন দেবেন। যদি মায়ের জিন হয় বাদামি/বাদামি, তাহলে তিনি সবসময়ই বাদামি দেবেন। ফলে সন্তানের ৭৫% সম্ভাবনায় বাদামি চুল ও ২৫% সম্ভাবনায় লাল চুল হবে। অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রেও একই রকম নিয়ম চলে, তবে বাস্তবিকভাবে সেগুলো আরও জটিল।

বহু-গুণফলক উত্তরাধিকার

[সম্পাদনা]

কিছু বৈশিষ্ট্য নির্ধারিত হয় জিন ও পরিবেশ উভয়ের মাধ্যমে। যেমন, উচ্চতা অনেকগুলো জিন দ্বারা নির্ধারিত হয়—কিছু “লম্বা” জিন, কিছু “খাটো” জিন। একটি শিশু যদি দুজন অভিভাবকের কাছ থেকে সব “লম্বা” জিন পায়, তবে সে বাবা-মার থেকেও লম্বা হতে পারে। আবার সব “খাটো” জিন পেলে সবচেয়ে খাটো হতে পারে। সাধারণত শিশুরা “লম্বা” ও “খাটো” উভয় ধরনের জিন পেয়ে গড়পড়তা উচ্চতা পায়।

ভালো খাবার ও ব্যায়াম “খাটো” জিনের শিশুকেও গড় উচ্চতায় পৌঁছাতে সাহায্য করে। কিন্তু কিছু পরিবেশগত প্রভাবও জেনেটিক সমস্যার সৃষ্টি করে। যেমন, মা যদি গর্ভাবস্থায় মাদক বা অ্যালকোহল সেবন করেন, তবে শিশু তা গ্রহণ করে। এমন শিশুদের বিকাশজনিত সমস্যা ও শেখার অক্ষমতা দেখা দেয়।

ফিটাল অ্যালকোহল সিন্ড্রোম-এ আক্রান্ত শিশুরা সাধারণত অস্বাভাবিকভাবে খাটো, ছোট চোখ ও চোয়াল, হৃদরোগ, ঠোঁট ও তালু ফাটা, খাওয়া ও ঘুমের সমস্যা, ও সহজেই উত্তেজিত হয়ে পড়ে। প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন এই রোগে আক্রান্ত শিশু জন্মের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মারা যায়। যারা বাঁচে, তাদের শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধকতা দেখা যায়।

মডিফাইং এবং রেগুলেটর জিন

[সম্পাদনা]

মডিফাইং এবং রেগুলেটর জিন দুই ধরনের জিন যা অন্য জিনের কার্যকারিতার উপর প্রভাব ফেলতে পারে। মডিফাইং জিন অন্য জিনগুলোর বহিঃপ্রকাশ কীভাবে হবে তা পরিবর্তন করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, একটি আধিপত্যশীল ছানিপড়া জিন চোখের দৃষ্টিশক্তিতে বিভিন্ন মাত্রার প্রভাব ফেলতে পারে, এটি নির্ভর করে সহকারী একটি নির্দিষ্ট মডিফাইং জিনের অ্যালিল উপস্থিত আছে কি না তার উপর। তবে ছানিপড়া অতিরিক্ত অতি-বেগুনি রশ্মি বা ডায়াবেটিস থেকেও হতে পারে।

রেগুলেটর জিন যাদের হোমিওটিক জিন নামেও ডাকা হয়, তারা অন্যান্য জিনের বহিঃপ্রকাশ শুরু করতে বা বন্ধ করতে পারে। এরা উদ্ভিদ ও প্রাণীতে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিকের নিয়ন্ত্রণও করে। উদাহরণস্বরূপ, রেগুলেটর জিন নির্দিষ্ট কিছু প্রোটিন কখন তৈরি হবে তা নিয়ন্ত্রণ করে, যেগুলো আমাদের শরীরের নতুন গঠন তৈরি করে। রেগুলেটর জিন শিশুর গর্ভধারণের পরপরই দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গঠনের কাজ শুরু করে এবং আমাদের শরীরে বয়সজনিত পরিবর্তনগুলোর জন্যও দায়ী। তারা বার্ধক্য এবং শারীরিক পরিপক্বতার প্রক্রিয়াগুলো নিয়ন্ত্রণ করে।

অসম্পূর্ণ বহিঃপ্রকাশ

[সম্পাদনা]

কিছু জিনের বহিঃপ্রকাশ অসম্পূর্ণ অর্থাৎ পরিবেশগত কিছু উপাদান না থাকলে এই জিনের প্রভাব প্রকাশ পায় না। উদাহরণস্বরূপ, আপনি ডায়াবেটিসের জিন পেতে পারেন, কিন্তু যদি আপনি অতিরিক্ত মানসিক চাপের মধ্যে না থাকেন, চরমভাবে অতিরিক্ত ওজন না হয়, অথবা রাতে পর্যাপ্ত ঘুম না হয়, তাহলে হয়তো ডায়াবেটিস হবে না।

বংশগত জেনেটিক রোগ

[সম্পাদনা]

সবচেয়ে সাধারণ কিছু বংশগত রোগ হলো হেমোক্রোমাটোসিস, সিস্টিক ফাইব্রোসিস, সিকল সেল অ্যানিমিয়া এবং হিমোফিলিয়া। এই সব রোগ বাবা-মার কাছ থেকে সন্তানের মধ্যে সঞ্চারিত হয় এবং এমনকি বাবা-মায়ের মধ্যে রোগের লক্ষণ না থাকলেও তারা বহনকারী হতে পারেন। অর্থাৎ, তাদের প্রতিটি সন্তানের এই রোগ নিয়ে জন্মানোর সম্ভাবনা থাকে। গর্ভাবস্থায় জেনেটিক টেস্টের মাধ্যমে জানা যায় শিশুর মধ্যে এই রোগগুলোর কোনটি রয়েছে কিনা।

হেমোক্রোমাটোসিস

[সম্পাদনা]
হেমোক্রোমাটোসিস টাইপ ১-৩ অটোসোমাল রিসেসিভ পদ্ধতিতে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া যায়।
হেমোক্রোমাটোসিস টাইপ ৪ অটোসোমাল ডমিন্যান্ট পদ্ধতিতে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া যায়।

অনেকেই হেমোক্রোমাটোসিস নামটি শুনেননি, কিন্তু এটি হলো সবচেয়ে সাধারণ উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া রোগ। প্রতি ৩০০ জনে একজন এই রোগ নিয়ে জন্মায় এবং প্রতি ৯ জনে একজন এর বাহক। এই রোগের মূল বৈশিষ্ট্য হলো শরীরে অতিরিক্ত আয়রনের শোষণ।

আয়রন হিমোগ্লোবিনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু অতিরিক্ত আয়রন ঠিক যতটা ক্ষতিকর, ঠিক ততটাই ক্ষতিকর খুব কম আয়রন। এই রোগে শরীরের প্রায় সব বড় অঙ্গ — বিশেষ করে যকৃত, হৃদপিণ্ড ও অগ্ন্যাশয়ে আয়রনের জমা তৈরি হয়, যা অঙ্গগুলোর সম্পূর্ণ বিকলতার দিকে নিয়ে যায়।

হেমোক্রোমাটোসিস রোগীরা সাধারণত প্রয়োজনের তুলনায় দুই থেকে তিন গুণ বেশি আয়রন শোষণ করে। এই রোগ প্রথম ১৮৬৫ সালে আবিষ্কৃত হয় এবং অধিকাংশ রোগীর পূর্বপুরুষ সেল্টিক বংশোদ্ভূত, যাদের ইতিহাস ৬০ থেকে ৭০ প্রজন্ম পেছনে যায়।

হেমোক্রোমাটোসিসের চিকিৎসা

[সম্পাদনা]

এই রোগের সবচেয়ে সাধারণ চিকিৎসা হলো অ্যানিমিয়া সৃষ্টি করে সেটিকে বজায় রাখা যতক্ষণ না শরীরের আয়রনের মজুদ কমে আসে। এই চিকিৎসায় থেরাপিউটিক ফ্লেবোটমি (রক্তদানের মাধ্যমে চিকিৎসা) করা হয়।

ফ্লেবোটমি বলতে বোঝানো হয় এক ইউনিট রক্ত (প্রায় ৫০০ মিলি) শরীর থেকে বের করে দেওয়া। এটি সপ্তাহে এক বা দুইবার করতে হয় এবং পুরো প্রক্রিয়া শেষ হতে কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস বা এমনকি বছরও লাগতে পারে।

চিকিৎসা শেষে কিছু রোগীর আর কখনও এটি করার দরকার হয় না, আবার কারও বারবার করতে হয়। যাঁরা নিয়মিত চিকিৎসা নেন, তাঁরা সাধারণত দীর্ঘ এবং সুস্থ জীবন যাপন করেন। আর যাঁরা চিকিৎসা নেন না, তাঁদের অঙ্গ বিকল বা মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যায়।

রোগীদের কম আয়রনের খাদ্য খাওয়া উচিত এবং আয়রনের তৈরি পাত্রে রান্না করা এড়িয়ে চলা উচিত।

সিস্টিক ফাইব্রোসিস

[সম্পাদনা]

সিস্টিক ফাইব্রোসিস এমন একটি রোগ, যা ফুসফুস ও পরিপাকতন্ত্রে ঘন ও আঠালো মিউকাস তৈরি করে। এটি শিশু ও তরুণদের মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ ফুসফুসজনিত রোগ এবং এতে অল্প বয়সেই মৃত্যু হতে পারে।

মিউকাস ফুসফুসের শ্বাসনালী ও অগ্ন্যাশয়ে জমে যায়। এর ফলে তীব্র সংক্রমণ ও হজমে সমস্যা দেখা দেয়। এছাড়াও এটি ঘামগ্রন্থি ও পুরুষদের প্রজনন ব্যবস্থায় সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

এই রোগের জন্য দায়ী CF জিনের ১০০০-এরও বেশি রূপান্তর আছে, যার ফলে উপসর্গ একেকজনের ক্ষেত্রে একেকরকম হয়।

সাধারণ উপসর্গগুলো হলো: জন্মের পর প্রথম ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টায় মলত্যাগ না হওয়া, হালকা বা মাটির রঙের পায়খানা, দুর্গন্ধযুক্ত বা ভাসমান মল, শিশুর ত্বক লবণাক্ত স্বাদযুক্ত হওয়া, ঘন ঘন নিউমোনিয়ার মতো সংক্রমণ, কাশি বা হাঁপানি, ওজন হ্রাস বা ওজন না বাড়া, ডায়েরিয়া, বৃদ্ধি বিলম্বিত হওয়া এবং অতিরিক্ত ক্লান্তি।

অধিকাংশ রোগীর বয়স এক বছর হওয়ার আগেই রোগ শনাক্ত হয়, তবে হালকা ক্ষেত্রে ১৮ বছরের পরও ধরা পড়তে পারে। বর্তমানে প্রায় ৪০% রোগীর বয়স ১৮ বছরের বেশি। CF রোগীদের গড় আয়ু এখন প্রায় ৩৫ বছর, যা গত ৩০ বছরে অনেক বেড়েছে। বেশিরভাগ রোগীর মৃত্যু ফুসফুসজনিত জটিলতায় হয়।

CFTR প্রোটিন - CFTR প্রোটিনের আণবিক গঠন

সিস্টিক ফাইব্রোসিসের চিকিৎসা

[সম্পাদনা]

২০০৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন প্রথম DNA ভিত্তিক রক্ত পরীক্ষার অনুমোদন দেয়, যা CF শনাক্তে সাহায্য করে।

CF শনাক্তের অন্যান্য পরীক্ষা হলো: ঘাম ক্লোরাইড পরীক্ষা — এটি CF শনাক্তে সবচেয়ে প্রচলিত পদ্ধতি। ঘামে লবণের মাত্রা বেশি থাকলে CF এর ইঙ্গিত দেয়।

আরও কিছু পরীক্ষা হলো: মলের চর্বি পরীক্ষা, আপার জিআই ও স্মল বাওয়েল সিরিজ, এবং অগ্ন্যাশয়ের কার্যকারিতার পরিমাপ।

রোগ নির্ধারিত হওয়ার পর নিচের চিকিৎসাগুলো দেওয়া হয়ে থাকে: শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক, অগ্ন্যাশয় এনজাইম প্রতিস্থাপন, ভিটামিন (বিশেষ করে A, D, E এবং K) সাপ্লিমেন্ট, শ্বাসনালী খোলার জন্য ইনহেলার, কফ সহজে বের করার জন্য এনজাইম থেরাপি, ব্যথানাশক ওষুধ এবং খুব গুরুতর ক্ষেত্রে ফুসফুস প্রতিস্থাপন।

সিকেল সেল অ্যানিমিয়া

[সম্পাদনা]

সিকেল সেল অ্যানিমিয়া হলো লাল রক্তকণিকার একটি বংশগত রোগ, যা রক্তকণিকার অস্বাভাবিক আকারের কারণে হয়। সাধারণভাবে একটি লাল রক্তকণিকায় প্রায় ২৭ কোটি হিমোগ্লোবিন অণু থাকে। যা অক্সিজেনের সঙ্গে যুক্ত হয়। সিকেল সেল রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির হিমোগ্লোবিন অণুতে একটি অ্যামিনো অ্যাসিড পরিবর্তিত থাকে, যার ফলে লাল রক্তকণিকার স্বাভাবিক গঠন বিকৃত হয়ে যায়। এই রোগে আক্রান্তদের রক্তকণিকা গোলাকার না হয়ে কাস্তে বা "C" আকার ধারণ করে। এই অস্বাভাবিক গঠন রক্তনালীর মধ্যে আটকে যেতে পারে ফলে রক্তপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি হয়।

এই কারণে ব্যথা হয় এবং পর্যাপ্ত অক্সিজেন না পাওয়ায় শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। সিকেল সেল মাত্র ১০ থেকে ২০ দিন বেঁচে থাকে, যেখানে একটি স্বাভাবিক রক্তকণিকা প্রায় ১২০ দিন টিকে থাকে।

সিকেল সেল মিউটেশনসহ লাল রক্তকণিকা।

এই দ্রুত রক্তকণিকা ধ্বংস হওয়ার কারণে দীর্ঘস্থায়ী অ্যানিমিয়া দেখা দেয়।

জটিলতার মধ্যে তীব্র ব্যথা, গুরুতর সংক্রমণ, হাত ও পায়ে ফোলা, স্ট্রোক, চোখের ক্ষতি ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্ষতি অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। এসব লক্ষণ ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে, কারণ তাদের সিকেল সেল রোগের ধরন ভিন্ন হয়। কেউ কেউ বেশিরভাগ সময় সুস্থ থাকে, আবার কেউ কেউ বারবার হাসপাতালে ভর্তি হয়।

উন্নত পরীক্ষা ও চিকিৎসার ফলে বর্তমানে সিকেল সেলে আক্রান্ত শিশুদের বেশিরভাগই স্বাভাবিক ও অপেক্ষাকৃত সুস্থ জীবন পায়। সিকেল সেলের ধরন নির্ভর করে শিশুটি বাবা-মায়ের কাছ থেকে কী ধরণের জিন পেয়েছে তার উপর। যদি একটি শিশু বাবা ও মায়ের কাছ থেকে সিকেল সেল জিন পায়, তবে তা হিমোগ্লোবিন এসএস রোগ (সিকেল সেলের মূল রূপ) হিসেবে পরিচিত।

যদি একটি সিকেল সেল জিন এবং অন্য একটি ভিন্ন অস্বাভাবিক জিন থাকে, তবে এটি হিমোগ্লোবিন এসসি রোগ বা হিমোগ্লোবিন S-থ্যালাসেমিয়া নামে পরিচিত। যদি একজন অভিভাবক থেকে স্বাভাবিক জিন এবং অন্যজন থেকে সিকেল সেল জিন পায়, তবে শিশুটি নিজে সিকেল সেলে আক্রান্ত হবে না, তবে বাহক হবে এবং তার সন্তানদের মধ্যে এটি ছড়াতে পারে।

সিকেল সেল মূলত আফ্রিকান আমেরিকান ও কিছু লাতিন আমেরিকানদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। যারা বাহক (একটি মাত্র সিকেল সেল জিন আছে) তারা ম্যালেরিয়ার প্রতি প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এই হেটারোজাইগাস সুবিধা ব্যাখ্যা করে কেন এই জিন বিষুবীয় অঞ্চলের মানুষের মধ্যে বেশি পাওয়া যায় অথবা তাদের বংশধরদের মধ্যে (যেমন আফ্রিকান আমেরিকানদের মধ্যে)।

সিকেল সেল অ্যানিমিয়ার চিকিৎসা

[সম্পাদনা]

জন্মের সময় একটি সাধারণ রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে সিকেল সেল নির্ণয় করা যায়। প্রথম পরীক্ষায় যদি ফলাফল ইতিবাচক হয়, তাহলে নিশ্চিত হওয়ার জন্য দ্বিতীয় পরীক্ষা করা হয়। সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি থাকায় এই রোগে প্রাথমিক নির্ণয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট ছাড়া এই রোগের কোনো নিরাময় নেই। তবে এই পদ্ধতিতে প্রত্যাখ্যানের সম্ভাবনা বেশি এবং এটি সবার জন্য প্রযোজ্য নয়। রোগীকে এমন একজন ডোনারের প্রয়োজন যাঁর সঙ্গে বোন ম্যারো মেলে এবং প্রত্যাখ্যানের ঝুঁকি কম থাকে।

যদিও এখনো নিরাময় নেই, কিন্তু ব্যথানাশক ও অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসা ব্যবহারের মাধ্যমে শিশুরা দীর্ঘ ও আনন্দময় জীবন যাপন করতে পারে। তীব্র ব্যথার সময় রক্ত সঞ্চালনও ব্যবহার করা হয়।

যেসব প্রাপ্তবয়স্ক বছরে তিনবার বা তার বেশি ব্যথার কারণে ভোগেন, তাদের জন্য একটি ক্যান্সার চিকিৎসার ওষুধ হাইড্রোক্সিউরিয়া অনুমোদিত হয়েছে, যা উপসর্গ কমাতে সাহায্য করে। এই ওষুধ সিকেল সেলের নমনীয়তা বাড়িয়ে কাজ করে বলে মনে করা হয়।

হিমোফিলিয়া

[সম্পাদনা]

যাদের হিমোফিলিয়া রয়েছে, তাদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ এটি উত্তরাধিকারসূত্রে পায়। বাকি এক-তৃতীয়াংশের ক্ষেত্রে রোগটির নির্দিষ্ট কারণ জানা যায় না। হিমোফিলিয়ার দুইটি ধরন রয়েছে: টাইপ A এবং টাইপ B। দুটি ক্ষেত্রেই রক্তে এক ধরনের প্রোটিনের ঘাটতি বা অনুপস্থিতি দেখা যায়। এই প্রোটিন ছাড়া রক্ত জমাট বাঁধতে পারে না।

হিমোফিলিয়ার কিছু উপসর্গ হলো: অস্থিসন্ধিতে রক্তপাত, হাঁটু ও গোড়ালিতে ফোলা, ব্যথা ছাড়াই অস্থিসন্ধিতে শক্তভাব, অতিরিক্ত উষ্ণতার সঙ্গে অস্থিসন্ধি শক্ত হওয়া (সাধারণ চলাফেরার ক্ষমতা হারায়), প্রস্রাব বা মলের সঙ্গে রক্ত, দাঁত পড়ার পর অতিরিক্ত রক্তপাত, অপারেশনের পর অতিরিক্ত রক্তপাত, সহজে রক্ত জমাট বাঁধা না হওয়া, অস্বাভাবিক ঋতুস্রাব, এবং দীর্ঘ সময় ধরে নাক দিয়ে রক্তপাত।

হিমোফিলিয়া রোগীদের রক্ত সাধারণ মানুষের মতো জমাট বাঁধে না। রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়ায় প্লেটলেট, ক্যালসিয়াম এবং টিস্যু ফ্যাক্টর একসঙ্গে কাজ করে। কিন্তু হিমোফিলিয়ায় এই জমাট বাঁধার উপাদান অনুপস্থিত অথবা কার্যকরভাবে কাজ করে না, ফলে রক্তপাত দীর্ঘস্থায়ী হয়।

সাধারণ একটি ভুল ধারণা হলো, হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি সামান্য কাটা-ছেঁড়াতেই রক্তক্ষরণে মারা যেতে পারেন বা তাদের রক্ত সাধারণের তুলনায় দ্রুত প্রবাহিত হয়—এটি সঠিক নয়।

হিমোফিলিয়ার কিছু ঝুঁকি হলো: অস্থিসন্ধির ক্ষত বা রোগ, চোখে রক্তপাত থেকে দৃষ্টিশক্তি হ্রাস, রক্তক্ষরণজনিত দীর্ঘস্থায়ী অ্যানিমিয়া, স্নায়ুজনিত বা মানসিক সমস্যা, এবং অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যু (বিশেষ করে মস্তিষ্ক বা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে)।

বেশিরভাগ হিমোফিলিয়া উত্তরাধিকারসূত্রে হয়ে থাকে, তবে ভিটামিন K-এর ঘাটতি, লিভারের রোগ, বা দীর্ঘদিন অ্যান্টিবায়োটিক ও রক্তপাতরোধী ওষুধ গ্রহণের কারণেও হতে পারে।

হিমোফিলিয়া সবচেয়ে বেশি গবেষণাপ্রাপ্ত রক্তক্ষরণজনিত রোগ হওয়ায় এই রোগে আক্রান্তরা অন্যান্য রক্তক্ষরণ রোগীদের তুলনায় কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন।

হিমোফিলিয়ার চিকিৎসা

[সম্পাদনা]

হিমোফিলিয়ার চিকিৎসায় প্রয়োজন ক্লটিং ফ্যাক্টর। এটি গুঁড়া আকারে থাকে একটি ছোট, জীবাণুমুক্ত কাঁচের বোতলে। এটি ফ্রিজে রাখতে হয়। প্রয়োজনে এটি জীবাণুমুক্ত পানির সঙ্গে মিশিয়ে এক মিনিট পর শিরায় ইনজেকশন দেওয়া হয়। কখনো কখনো এটি বেশি পরিমাণে পানি মিশিয়ে চার এর মাধ্যমেও দেওয়া যায়।

হিমোফিলিয়া নিয়ে কাজ করে এমন ১৪০টির বেশি বিশেষায়িত কেন্দ্র রয়েছে। এর অধিকাংশই "কমপ্রিহেনসিভ কেয়ার ফ্যাসিলিটি"। এই কেন্দ্রে হিমোফিলিয়া আক্রান্ত রোগী ও তাদের পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় সকল সেবা প্রদান করা হয়—প্রাথমিক চিকিৎসক, নার্স, ফিজিওথেরাপিস্ট ও বিশেষজ্ঞ দন্তচিকিৎসক অন্তর্ভুক্ত। কারণ হিমোফিলিয়ায় আক্রান্তদের দাঁতের চিকিৎসায় অতিরিক্ত রক্তপাতের ঝুঁকি বেশি থাকে।

সাধারণত বছরে দুইবার এই কেন্দ্রে সম্পূর্ণ শারীরিক পরীক্ষা করানো সুপারিশ করা হয়।

হিমোফিলিয়া A ও B রোগীদের জন্য মূল চিকিৎসা হলো ফ্যাক্টর রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি। এই থেরাপিতে ইনজেকশনের মাধ্যমে ফ্যাক্টর আট ও নয় (VIII ও IX) দেওয়া হয়, যা রক্তপাত নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। এই ফ্যাক্টর দুটি আসে দুটি উৎস থেকে: মানব প্লাজমা ও ডিএনএ প্রযুক্তিতে তৈরি জিন প্রকৌশলী কোষ থেকে। এই ফ্যাক্টরই হলো সেই উপাদান যা হিমোফিলিয়ায় আক্রান্তদের জিনে অনুপস্থিত থাকে।

ইনজেকশন দেওয়ার পর রক্ত কয়েক ঘণ্টার জন্য "স্বাভাবিক" থাকে এবং এই সময়ে ক্ষতস্থানে জমাট বাঁধার সুযোগ হয়। এই চিকিৎসা স্থায়ী নয়—প্রায় তিন দিনের মধ্যে এর প্রভাব শেষ হয়ে যায়।

বর্তমানের ফ্যাক্টর চিকিৎসাগুলো আগের তুলনায় অনেক বেশি কার্যকর, তাই বড় অস্ত্রোপচার বা বড় আঘাতেও কম পরিমাণে প্রয়োজন হয়। এই চিকিৎসা ঘরেই ফ্রিজে ছয় মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। আঘাত লাগলে হাসপাতালে না গিয়েও রোগী নিজে ইনজেকশন দিতে পারেন। ইনজেকশনের পর জমাট বাঁধার প্রক্রিয়া শুরু হতে ১৫–২০ মিনিট লাগে।

মানব প্লাজমা থেকে তৈরি ফ্যাক্টর (আট) ব্যবহারে এইচআইভি এইডস-এর সংক্রমণের ঝুঁকি ছিল, তবে প্রযুক্তির উন্নতিতে এই ঝুঁকি অনেক কমে গেছে। জিন প্রকৌশলে তৈরি ফ্যাক্টর আট থেকে কোনো রোগ ছড়ানোর আশঙ্কা নেই।

হিমোফিলিয়া রোগীরা দীর্ঘ জীবন যাপন করতে পারেন। আগে রোগীদের মৃত্যুর প্রধান কারণ ছিল এইডস সম্পর্কিত জটিলতা।

অবংশগত জিনগত রোগ

[সম্পাদনা]
২১ ট্রাইসোমি-ডাউন সিনড্রোমের ক্যারিওটাইপ

যে কোনো রোগ যা সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে পিতামাতার কাছ থেকে সন্তানের মধ্যে বংশগতভাবে জিনগত ত্রুটির মাধ্যমে সঞ্চারিত হয়, তাকে জিনগত রোগ বলা হয়। এসব রোগের জিন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সঞ্চারিত হয় এবং অনেক সময় শিশুর আত্মীয়দের মধ্যে একই রোগ পাওয়া যায়। কিছু জিনগত রোগ আবার আকস্মিক জিনগত ত্রুটির কারণে দেখা দেয়, যার ফলে কোনো পারিবারিক ইতিহাস ছাড়াই শিশু জন্মগতভাবে রোগে আক্রান্ত হয়।

ডাউন সিনড্রোম, যা ট্রাইসোমি ২১ নামেও পরিচিত, এটি একটি ক্রোমোজোমজনিত ত্রুটি যা প্রতি ৮০০–১০০০ নবজাতকের মধ্যে একজনকে প্রভাবিত করে। মিয়োসিসের অ্যানাফেস দুই পর্যায়ে ক্রোমোজোম ২১-এর সিস্টার ক্রোমাটিড আলাদা হতে ব্যর্থ হয়, যার ফলে অতিরিক্ত একটি ক্রোমোজোমসহ ডিম্বাণু তৈরি হয় এবং ভ্রূণে তিনটি ক্রোমোজোম থাকে (ট্রাইসোমি)। জন্মের সময় এই ত্রুটি শনাক্ত করা যায় চোখের বাদামি আকৃতি, সমতল মুখাবয়ব, এবং স্বাভাবিকের চেয়ে কম পেশি শক্তি দেখে।

গর্ভাবস্থায় অ্যাম্নিওসেন্টেসিস পরীক্ষার মাধ্যমে ডাউন সিনড্রোম শনাক্ত করা সম্ভব। তবে এতে ভ্রূণের ঝুঁকি থাকায় ৩৫ বছরের বেশি বয়সী নারীদের ক্ষেত্রেই এই পরীক্ষা সুপারিশ করা হয়।

অন্যান্য প্রাণঘাতী নয় এমন ক্রোমোজোম ত্রুটির মধ্যে রয়েছে অতিরিক্ত যৌন ক্রোমোজোম। উদাহরণস্বরূপ, একজন মেয়ে শিশুর (প্রতি ২৫০০ জনে ১ জন) দুটি X থাকার পরিবর্তে একটি X থাকলে (XO), এতে শারীরিক বিকৃতি ও প্রজনন সমস্যা হতে পারে। ছেলেরা অতিরিক্ত X (XXY বা XXXY) নিয়ে জন্মালে তাদেরও প্রজনন সমস্যা এবং মাঝে মাঝে মানসিক প্রতিবন্ধকতা হতে পারে।

ক্রোমোজোমজনিত ত্রুটি এই ধরনের ত্রুটিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে শরীরের সব কণিকাই প্রভাবিত হয়। ত্রুটির প্রভাব খুব সামান্য থেকে প্রাণঘাতী পর্যন্ত হতে পারে। প্রতি ২০০ নবজাতকের মধ্যে ১ জন কোনো না কোনো ক্রোমোজোম ত্রুটিসহ জন্মায়, এবং এর মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রে গর্ভপাত ঘটে।

ত্রুটিগুলো সাধারণত নিষিক্তকরণের কিছুক্ষণের মধ্যেই তৈরি হয় এবং বাবা-মার মধ্যে একজনের কাছ থেকেও এই ত্রুটি পাওয়া যেতে পারে। এসব ত্রুটির কোনো চিকিৎসা নেই। গর্ভাবস্থার প্রাথমিক পর্যায়ে পরীক্ষা করে যদি ত্রুটি ধরা পড়ে তবে পিতামাতার গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ থাকে।

মিউট্যান্ট জিন

[সম্পাদনা]

মিউটেশন হলো ডিএনএ এর একটি অংশে স্থায়ী পরিবর্তন।

মিউটেশন হলো কোষের জিনগত উপাদানে পরিবর্তন। মিউটেশন ঘটাতে পারে এমন পদার্থকে বলা হয় মিউটাজেন। এই মিউটাজেন হতে পারে এক্স-রে, সূর্যের রশ্মি, পৃথিবীর বিষাক্ত পদার্থ, বাতাস, পানি বা ভাইরাস। অনেক জিনগত মিউটেশন সম্পূর্ণ ক্ষতিকারক নয়, কারণ তা প্রোটিন তৈরির অ্যামিনো অ্যাসিড বিন্যাস পরিবর্তন করে না।

মিউটেশন ভালো, খারাপ বা নিরপেক্ষ হতে পারে। কখনো এটি মূল জিনের চেয়ে বেশি কার্যকর বা শক্তিশালী হয়—যা উপকারী। আবার এটি জীবের টিকে থাকার সক্ষমতা নষ্ট করতে পারে—যা ক্ষতিকর। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এটি নিরপেক্ষ, অর্থাৎ মিউটেশন হওয়ার পরও তার কোনো কার্যকর পরিবর্তন দেখা যায় না।

ক্ষতিকারক কিছু মিউটেশন ক্যান্সার, জন্মগত ত্রুটি এবং বংশগত রোগের কারণ হতে পারে। সাধারণত কোষ বিভাজনের সময় এই মিউটেশন ঘটে। যখন একটি কোষ বিভাজিত হয়, তখন একটি কোষ ত্রুটিযুক্ত হয়ে পড়ে এবং তা পরবর্তী প্রতিটি কোষে ছড়িয়ে পড়ে।

টেরাটোজেন বলতে এমন পরিবেশগত উপাদানকে বোঝায় যা গর্ভাবস্থায় ভ্রূণের ক্ষতির কারণ হতে পারে। সাধারণ টেরাটোজেনগুলোর উদাহরণ:

  • ওষুধ: প্রেসক্রিপশন, নন-প্রেসক্রিপশন এবং অবৈধ ওষুধ
  • তামাক, অ্যালকোহল,
  • বিকিরণ,
  • পরিবেশ দূষণ,
  • সংক্রামক রোগ,
  • এসটিডি,
  • এইডস,
  • পরজীবী,

ভ্রূণের বিকাশের সংবেদনশীল সময়ে টেরাটোজেনের প্রভাব সবচেয়ে গুরুতর। ভ্রূণ পর্যায়ে ক্ষতিসাধন অপেক্ষাকৃত কম হয়।

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং

[সম্পাদনা]

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে কোনো বিজ্ঞানী ডিএনএ বা জিনকে পরিবর্তন করে, যাতে একটি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য যুক্ত করা যায় এবং অপ্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্যগুলো বাদ দেওয়া যায়। এই প্রক্রিয়া উদ্ভিদ, প্রাণী বা মানুষের উপর প্রয়োগ করা যেতে পারে।

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রধান উদ্দেশ্য হলো একটি নির্দিষ্ট প্রোটিন "বড় পরিমাণে উৎপাদন" করা। প্রতিটি কোষ একটি নির্দিষ্ট প্রোটিন তৈরি করে এবং এই প্রোটিনগুলো চিকিৎসা এবং রোগ নির্ণয়ে ব্যবহৃত হয়। প্রতিটি জিন জীবন্ত কোষে একটি নির্দিষ্ট প্রোটিন তৈরির নিয়ন্ত্রণ করে। যদি এমন একটি জিন খুঁজে পাওয়া যায় যা একটি গুরুত্বপূর্ণ বা দরকারী প্রোটিন তৈরি করে এবং যদি সেই জিনকে এমন একটি কোষে বসানো যায় যেটি নিজেকে পুনরুৎপাদন করতে পারে, তাহলে সেই কোষের একটি কলোনি তৈরি করা সম্ভব এবং প্রোটিনটি বিপুল পরিমাণে উৎপাদন করা যায়। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ইনসুলিন, গ্রোথ হরমোন, ভ্যাকসিন (যেমন হেপাটাইটিস প্রতিরোধে) এবং ভাইরাসজনিত সংক্রমণ প্রতিরোধে ব্যবহৃত ওষুধ তৈরি করা যায়। এটি হেমোফিলিয়ার চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ফ্যাক্টর আট তৈরিতেও সাহায্য করে।

প্রথম ধাপে, কাঙ্ক্ষিত প্রোটিন তৈরির জন্য দায়ী জিনটি কোষের ডিএনএ-তে খুঁজে বের করা হয়। এরপর সেই জিনটি হয়তো আলাদা করা হয় বা তার সঠিক রাসায়নিক গঠন নির্ণয় করে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়। সবশেষ ধাপে, ডিএনএ-টি বিশেষ এনজাইমের মাধ্যমে গ্রহণকারী কোষে প্রবেশ করানো হয়।

বংশগত রোগ নিরাময়ে প্রযুক্তিকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। আশা করা যায়, ভবিষ্যতে অনেক কম সংখ্যক শিশু বংশগত রোগ নিয়ে জন্মাবে।

জিন থেরাপি

[সম্পাদনা]

জিন থেরাপি হলো ত্রুটিযুক্ত জিনগুলোকে ঠিক করার একটি পদ্ধতি, যেগুলোর কারণে রোগ হয়। যখন জিনগুলো পরিবর্তিত হয়, তখন প্রোটিনগুলো স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারে না, যার ফলে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। বর্তমানে এই থেরাপি নিয়ে গবেষণা চলছে, তবে কিছু ক্ষেত্রে এটি খুবই কার্যকর।

জিন হলো বংশগতির মৌলিক শারীরিক এবং কার্যকর অংশ এবং এটি ক্রোমোজোমে থাকে। কোনো জিনগত রোগ থাকলে, জিন থেরাপির মাধ্যমে সমস্যাটি স্থায়ীভাবে অথবা অস্থায়ীভাবে সমাধান করা যায়। সবচেয়ে সাধারণ পদ্ধতিটি হলো একটি ত্রুটিপূর্ণ জিনের জায়গায় একটি কার্যকর জিন বসানো। আরেকটি পদ্ধতি হলো জিন বদল, যেখানে ত্রুটিপূর্ণ জিনের পরিবর্তে একটি স্বাভাবিক জিন বসানো হয়। আবার "নির্বাচিত রিভার্স মিউটেশন" এর মাধ্যমে জিনের আসল কাজ ফিরিয়ে আনা যায়। এছাড়াও, কোনো জিন কতটা সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় থাকবে, সেটিও পরিবর্তন করা যায়।

জিন থেরাপি একটি মৌলিক ধারণার উপর ভিত্তি করে কাজ করে — যে ধারণাটি হলো, ভাইরাসের জিনোম থেকে রোগ সৃষ্টিকারী অংশগুলো বাদ দিয়ে তার জায়গায় নতুন থেরাপিউটিক জিন বসানো যায়। এই নতুন জিনগুলোকে বলা হয় জিন থেরাপি ভেক্টর। (ভাইরাসের আবরণ হলো ভেক্টর এবং এর ভিতরের নতুন জিন হলো পেলোড।)

অ্যাডেনোভাইরাস ভেক্টরের সাহায্যে জিন থেরাপি। একটি নতুন জিন অ্যাডেনোভাইরাস ভেক্টরে ঢুকিয়ে তা মানব কোষে প্রবর্তন করা হয়। চিকিৎসা সফল হলে, নতুন জিনটি একটি কার্যকর প্রোটিন তৈরি করে।

জিন থেরাপির ভেক্টর হিসেবে যেসব ভাইরাস ব্যবহৃত হয়, সেগুলোর মধ্যে কয়েকটি হলো: রেট্রোভাইরাস - এই ভাইরাসগুলো তাদের আসল আরএনএ জিনোমের ডাবল-স্ট্র্যান্ডেড ডিএনএ কপি তৈরি করতে পারে। এই কপি হোস্ট কোষের ক্রোমোজোমে একীভূত হতে পারে। এইচআইভি একটি রেট্রোভাইরাস।

অ্যাডেনোভাইরাস এই ভাইরাসের ডাবল-স্ট্র্যান্ডেড ডিএনএ জিনোম রয়েছে এবং এটি মানুষের শ্বাসযন্ত্র, অন্ত্র এবং চোখে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। সাধারণ সর্দি একটি অ্যাডেনোভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট।

অ্যাডেনো-অ্যাসোসিয়েটেড ভাইরাস - এটি এক ধরনের ছোট, একক-স্ট্র্যান্ডেড ডিএনএ ভাইরাস যা ক্রোমোজোম ১৯-এর নির্দিষ্ট স্থানে তার জিনগত উপাদান প্রবেশ করাতে পারে। (ক্রোমোজোম ১৯ মানব জিনোমের প্রায় ২% গঠন করে এবং এতে প্রায় ১,৫০০ জিন থাকে। এর মধ্যে কিছু জিন ইনসুলিন-নির্ভর ডায়াবেটিস, মায়োটনিক ডিসট্রফি, মাইগ্রেন এবং বংশগত উচ্চ কোলেস্টেরলের জন্য দায়ী।)

হারপিস সিমপ্লেক্স ভাইরাস - এটি একটি ডাবল-স্ট্র্যান্ডেড ডিএনএ ভাইরাস যা নিউরন নামক নির্দিষ্ট কোষে সংক্রমণ ঘটায়। এই ভাইরাস ঠোঁটের ঘা সৃষ্টি করে এবং জিন থেরাপিতে ব্যবহৃত হয়।

জিন থেরাপিতে বড় অগ্রগতি হয়েছে। অনেক রোগ, যেগুলো বহু মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে, সেগুলোর চিকিৎসা ও নিরাময় এখন সম্ভব। পারকিনসনস, হান্টিংটনস, সিস্টিক ফাইব্রোসিস, কিছু ক্যান্সার, "বাবল বয়" সিনড্রোম এবং সিকল সেল সহ বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা এখন সম্ভব হয়েছে। প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতির ফলে হয়তো একদিন সব প্রাণঘাতী রোগের চিকিৎসা সম্ভব হবে।

বিকাশ ও হোমিওস্টেসিসে জেনেটিক নিয়ন্ত্রণ

[সম্পাদনা]

অনেকেই মনে করেন, জেনেটিক্স মানে আমি কেন নীল চোখ নিয়ে জন্মেছি যখন আমার বাবা-মায়ের চোখ বাদামী। অথবা, হেমোফিলিয়া কীভাবে মা থেকে ছেলের মাঝে সঞ্চারিত হয়, মেয়ের মাঝে নয়। কিন্তু জেনেটিক্স আসলে এর চেয়েও অনেক গভীর।

আপনি যখন গর্ভে ধারণ হন, তখন আপনি ছিলেন মাত্র একটি কোষ। সেই কোষ বিভাজিত হতে থাকে। আপনার ভর বা ওজন তখন বাড়েনি, শুধু কোষের সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু কোষের সংখ্যা একটা নির্দিষ্ট পরিমাণে পৌঁছালে পরিবর্তন শুরু হয়। আপনি তখন মায়ের শরীর থেকে পুষ্টি নিয়ে ওজন বাড়ানো শুরু করেন এবং কোষের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। এই সময়ে কোষগুলো বিশেষায়িত হতে শুরু করে। কিছু কোষ যকৃত (লিভার) হয়ে যায়, কিছু হৃদপিণ্ড, ফুসফুস, মস্তিষ্ক ইত্যাদি হয়ে যায়। কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব? কীভাবে সেই ছোট্ট কোষগুচ্ছ বুঝল যে কখন কী হতে হবে?

এর কারণ হলো, আপনার ডিএনএ পুরো শরীরের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখে। যদি তা না রাখত, তাহলে সেই কোষগুলো কেবল বিভাজিত হতে থাকত কিন্তু কখনো বিশেষায়িত হতো না, কোনো গঠন বা কার্যক্ষমতা পেত না। জেনেটিক নিয়ন্ত্রণের কারণে আপনার শরীর ঠিকভাবে গঠন পায়, সবকিছু সঠিক স্থানে তৈরি হয়।

এমনকি গর্ভাবস্থার পরে, জিন নিয়ন্ত্রণ ঠিক করে দেয় প্রতিটি কোষ কী তৈরি করবে এবং কীভাবে কাজ করবে। বারো বছর বয়সে শুধু হঠাৎ করে কৈশোর শুরু হয় না। বরং আপনার বৃদ্ধি ও বিকাশের কারণে ডিএনএ-র নির্দিষ্ট জিন সক্রিয় হয় এবং সেই জিনগুলো হরমোন উৎপাদনের জন্য এন্ডোক্রাইন সিস্টেমকে উদ্দীপিত করে। এর ফলেই আপনি যৌনভাবে পরিপক্ব হয়ে ওঠেন।

এমনকি বার্ধক্যও জেনেটিকভাবে নিয়ন্ত্রিত। যদিও এখানে জিন এক্সপ্রেশনের নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়নি, তবে জেনে রাখা ভালো যে, ডিএনএ থেকে আরএনএ-তে ট্রান্সক্রিপশন থেকে শুরু করে প্রোটিন তৈরি হওয়ার পরে তার পরিবর্তন (পোস্ট-ট্রান্সলেশনাল মডিফিকেশন) পর্যন্ত প্রতিটি ধাপই নিয়ন্ত্রিত হতে পারে। এই জিন নিয়ন্ত্রণ কোষকে তার গঠন ও কার্যক্ষমতার উপর নিয়ন্ত্রণ দেয় এবং কোষের পার্থক্য নির্ধারণে ভূমিকা রাখে।

কোনো কোষ পরিবেশগত পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়ায়ও তার জিন এক্সপ্রেশন পরিবর্তন করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, প্যানক্রিয়াসের কোষ যদি বেশি গ্লুকোজের সংস্পর্শে আসে, তাহলে সেটি তার সংরক্ষিত ইনসুলিন ছেড়ে দেয়। কিন্তু যদি গ্লুকোজের মাত্রা অনেকক্ষণ থাকে, তাহলে সেই কোষ ইনসুলিন তৈরির জিনের অতিরিক্ত কপি তৈরি করে এবং ইনসুলিন উৎপাদন বাড়ায়। এটিই হলো হোমিওস্টেসিস।

শব্দকোষ

[সম্পাদনা]

অ্যালিল: নির্দিষ্ট একটি ক্রোমোজোমের নির্দিষ্ট স্থানে থাকা একজোড়া জিনের একটি সদস্য।

অটোসোম: এমন একটি ক্রোমোজোম যা যৌন ক্রোমোজোম নয়।

ক্রোমোজোম: ডিএনএ ও সংশ্লিষ্ট প্রোটিনের সূতাসদৃশ একটি গঠন, যা কোষের নিউক্লিয়াসে থাকে এবং জিন বহন করে ও বংশগত তথ্য স্থানান্তরে কাজ করে।

সিস্টিক ফাইব্রোসিস: একটি রিসেসিভ জিনগত রোগ, যা ফুসফুসের মিউকাস আবরণকে প্রভাবিত করে, ফলে শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা ও অন্যান্য জটিলতা দেখা দেয়।

ফিটাল অ্যালকোহল সিনড্রোম: মায়ের গর্ভকালীন অতিরিক্ত (বা কখনো কখনো অল্প) অ্যালকোহল গ্রহণের ফলে শিশুর জন্মগত বিভিন্ন ত্রুটির সংমিশ্রণ।

জিন: নিউক্লিক অ্যাসিডের একটি খণ্ড, যার মধ্যে কার্যকর একটি প্রোটিন তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য থাকে।

জেনেটিক্স: জিন, বংশগতি ও জীবের বৈচিত্র্য নিয়ে গবেষণার বিজ্ঞান।

জিনোম: একটি জীবের সম্পূর্ণ জিনগত তথ্য, যার মধ্যে ডিএনএ ও আরএনএ অন্তর্ভুক্ত।

জিনোটাইপ: একটি জীবের প্রকৃত জিনের সমষ্টি। এটি জিনগত উপাদানের নকশা।

হিমোক্রোমাটোসিস: একটি বিপাকজনিত রোগ, যাতে লোহিত রক্তকণিকা শরীরের টিস্যু ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গে অতিরিক্ত লোহা জমা করতে থাকে; ফলে এই লোহা বিষাক্ত হয়ে শরীরে ক্ষতি করে।

হিমোগ্লোবিন: লোহিত রক্তকণিকার একটি উপাদান, যা অক্সিজেন বহন করে।

হিমোফিলিয়া: একটি বংশগত রোগগুচ্ছ, যেখানে আক্রান্ত ব্যক্তি রক্ত জমাট বাঁধাতে সহায়ক নির্দিষ্ট কিছু প্রোটিন ঠিকভাবে তৈরি করতে পারে না।

ইনহেরিটেন্স (বংশগত বৈশিষ্ট্য): সন্তানের মধ্যে পিতামাতার কাছ থেকে পাওয়া বৈশিষ্ট্য।

মডিফাইং জিন: অন্যান্য জিনের বহিঃপ্রকাশে (ফিনোটাইপে) প্রভাব ফেলে।

মাল্টিফ্যাক্টোরিয়াল ইনহেরিটেন্স: এমন বৈশিষ্ট্য বা রোগ যা একাধিক জিন এবং/অথবা পরিবেশগত কারণে ঘটে।

ফিনোটাইপ: একটি জীবের দৃশ্যমান শারীরিক বৈশিষ্ট্য।

পলিজেনিক: এমন বৈশিষ্ট্য যা একাধিক জিনের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়।

রেগুলেটর জিন: অন্যান্য জিনের প্রকাশ শুরু বা বন্ধ করতে পারে।

সেক্স-লিঙ্কড: এমন বৈশিষ্ট্য বা রোগ যা যৌন ক্রোমোজোম বা তাতে বহনকৃত জিন দ্বারা নির্ধারিত হয়।

সিকল সেল অ্যানিমিয়া: একটি রিসেসিভ রোগ, যেখানে রক্তকণিকা অস্বাভাবিক আকৃতি ধারণ করে এবং ফলে রক্ত চলাচলে সমস্যা দেখা দেয়।

সিনথেসাইজ: জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কোনো কিছু তৈরি করা।

ইউনিফ্যাক্টোরিয়াল ইনহেরিটেন্স: এমন বৈশিষ্ট্য বা রোগ যা একজোড়া জিন দ্বারা নির্ধারিত হয়।

জাইগোট: স্ত্রী ও পুরুষ গ্যামেট মিলনের ফলে তৈরি কোষ। এটি নিষিক্তকরণের পর প্রথম কোষ।

পুনরালোচনা প্রশ্নাবলী

[সম্পাদনা]
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া যাবে এখানে

১. ডিএনএ কোথায় থাকে?

ক) এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম
খ) রাইবোসোম
গ) ক্রোমোজোম
ঘ) সাইটোপ্লাজম

২. প্রতিটি কোষে সবগুলো জিনের একই কপি থাকা সত্ত্বেও, বিভিন্ন কোষ বিভিন্ন জিন __________ বা __________ করে

ক) প্রকাশ করে, দমন করে
খ) জিনোটাইপ, ফিনোটাইপ
গ) প্রাধান্যশীল, অপবাদী

৩. ডিপ্লয়েড জীবের ক্ষেত্রে, একটি ক্রোমোজোমে প্রাধান্যশীল অ্যালিল থাকলে তা

ক) অপবাদী অ্যালিলের প্রকাশ ঘটায়
খ) অপবাদী অ্যালিলের প্রকাশ ঢেকে দেয়
গ) বোঝায় যে দুটি ক্রোমোজোমেই প্রাধান্যশীল অ্যালিল আছে
ঘ) উপরের কোনোটিই নয়

৪. ট্রান্সক্রিপশন কোথায় ঘটে?

ক) সাইটোপ্লাজম
খ) গোলজি অ্যাপারাটাস
গ) মাইটোকন্ড্রিয়া
ঘ) নিউক্লিয়াস

৫. এটি এমআরএনএর শুরু কোডন এবং প্রতিটি এমআরএনএর শুরুতে থাকে

ক) AGU
খ) GAU
গ) UAG
ঘ) GUA
ঙ) AUG

৬. সারা সিস্টিক ফাইব্রোসিস নিয়ে জন্ম নিয়েছে, এ থেকে আমরা ধরে নিতে পারি—

ক) তার সব ভাইবোনেরও সিস্টিক ফাইব্রোসিস আছে
খ) শুধুমাত্র তার বাবা বাহক
গ) শুধুমাত্র তার মা বাহক
ঘ) তার বাবা ও মা উভয়েই বাহক

৭. জেসি চ্যাপ্টা মুখ, বাদামি চোখ ও কম পেশি টোন নিয়ে জন্মেছে; ধরে নেওয়া যায় যে তার—

ক) ক্রোমোজোম ২১-এ একটি অস্বাভাবিকতা আছে
খ) ক্রোমোজোম ১৯-এ একটি অস্বাভাবিকতা আছে
গ) ক্রোমোজোম ২০-এ একটি অস্বাভাবিকতা আছে
ঘ) ক্রোমোজোম ২২-এ একটি অস্বাভাবিকতা আছে
ঙ) কোনো ক্রোমোজোমে অস্বাভাবিকতা নেই, এগুলো তার বংশগত বৈশিষ্ট্য

৮. সবচেয়ে সাধারণ বংশগত রোগ কোনটি?

ক) হিমোক্রোমাটোসিস
খ) সিস্টিক ফাইব্রোসিস
গ) সিকল সেল অ্যানিমিয়া
ঘ) হিমোফিলিয়া
ঙ) উপরের সবগুলো

৯. সিকল সেল অ্যানিমিয়ার বাহক হওয়া মানে—

ক) হিমোফিলিয়ারও বাহক হওয়া
খ) ম্যালেরিয়ার প্রতিরোধশক্তি থাকা
গ) তার সব সন্তান সিকল সেল অ্যানিমিয়া নিয়ে জন্মাবে
ঘ) তার সব সন্তান ম্যালেরিয়া নিয়ে জন্মাবে
ঙ) উপরের কোনোটিই নয়

১০. হিমোফিলিয়া হলো—

ক) একটি Y-সংযুক্ত রোগ
খ) একটি XY-সংযুক্ত রোগ
গ) একটি X-সংযুক্ত রোগ